|
|
|
|
অভিযোগ সিপিএমের জেলা সম্মেলনে |
দলের মধ্যে ‘গণতন্ত্র কলুষিত হচ্ছে’ |
বরণ দে • মেদিনীপুর |
পার্টির অভ্যন্তরে গণতন্ত্র ‘কলুষিত’ হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেল সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্মেলনে। রাজ্য নেতৃত্বের সামনেই প্রতিনিধিদের একাংশ অভিযোগ করলেন, “নিচুতলার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়াই হয় না। উপর থেকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়। এমন চলতে থাকলে সংগঠনের শক্তি-বৃদ্ধি হবে কী করে!”
সম্মেলনে মেদিনীপুরের এক প্রতিনিধি বলেন, “পার্টির অভ্যন্তরে গণতন্ত্র কলুষিত হচ্ছে। কেন্দ্রিকতা প্রাধান্য পাচ্ছে। এখনকার প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সেটা আরওই অনভিপ্রেত।” তাঁর বক্তব্য, “পার্টিকে সম্প্রসারিতে করতে হলে নিচুতলার মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে।” ‘সক্রিয়তা’র প্রশ্নেও নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন একাধিক প্রতিনিধি। গড়বেতার এক প্রতিনিধি অভিযোগ করেন, “যে সময়ে সাধারণ কর্মী-সমর্থকেরা আক্রান্ত হচ্ছেন, সেই সময়ে জেলা নেতৃত্বকে সে ভাবে পাশে পাওয়াই যাচ্ছে না।” তাঁর কথায়, “রাজ্যে পালাবদলের পরেই গড়বেতায় খুন হয়েছিলেন জোনাল কমিটির সদস্য জিতেন নন্দী। অথচ, জেলা সম্পাদক গড়বেতায় গিয়ে নিহত কর্মীর পরিবারের পাশে পর্যন্ত দাঁড়াননি। জেলা সম্পাদক ওই সময়ে গড়বেতায় গেলে নিচুতলার কর্মীরা ‘সাহস’ পেতেন।” দলীয় সূত্রে খবর, ঝাড়গ্রাম, বেলদা, কেশপুরের প্রতিনিধিরা ঘুরফিরেই জেলা সম্পাদক দীপক সরকার ও তাঁর অনুগামীদের বিরুদ্ধে নাম না-করে নানা অভিযোগ এনেছেন।
জবাবি ভাষণে অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগই কৌশলে অস্বীকার করেছেন দীপকবাবু। কখনও তিনি বিষয়ের মধ্যে না-ঢুকেই পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন। যেমন, মেদিনীপুরের প্রতিনিধির বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা সম্পাদক বলেন, “নিচুতলার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বুঝতে পারলাম না এ ক্ষেত্রে ঠিক কী বলতে চাওয়া হয়েছে।” গড়বেতার প্রতিনিধির বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর মন্তব্য, “ওই সময়ে গড়বেতায় যাওয়া ঠিক হবে না-বলে মনে হয়েছিল। দলীয়স্তরে আলোচনা করেই এই সিদ্ধান্ত নিই। তবে দলীয় প্রতিনিধিদল গিয়েছিল।” তবে নিজের প্রতিবেদনে দীপকবাবু স্বীকার করেছেন, “জেলায় ১৫ বছর ধরে বিভিন্ন ক্রুটি সংশোধনের অভিযান চলছে। কিন্তু ক্রুটিগুলি থেকেই যাচ্ছে। এর ফলে জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে।”
বর্তমান পরিস্থিতি যে ‘প্রতিকূল’, তা-ও সম্পাদকের খসড়া প্রতিবেদনে স্পষ্ট। আগের সম্মেলন-পর্ব থেকে এই সম্মেলনের মধ্যে জেলায় ৩৫০ জন পার্টি-সদস্য বহিষ্কৃত হয়েছেন, ৬৬৬৯ জনের সদস্যপদ খারিজ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। সংখ্যাটা ‘উদ্বেগজনক’, মানছেন দলের একাধিক নেতাও। এর মধ্যেও অবশ্য ১২১৯ জন সদস্য বৃদ্ধি ঘটেছিল। কিন্তু বিধানসভা ভোট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ৫৭৪ জন সদস্য কমেছে (সদস্য-সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪ হাজার ২৮৫)। গত সম্মেলনের সময়ে সর্বক্ষণের-কর্মী সংখ্যা ছিল ৬৬৮। এই সংখ্যা বেড়ে ২০১১-এর পুনর্নবীকরণের সময়ে হয়েছে মাত্রই ৬৮৮। এই বৃদ্ধি যে লক্ষ্যের তুলনায় সামান্যই, তা-ও মানছেন একাধিক নেতা। ২০০৭ সালে সম্মেলনের আগে পর্যন্ত জেলায় গণশক্তি আসত ১৫ হাজার ৭৯৭টি। পরে সংখ্যাটা বেড়ে ২০১১-র এপ্রিল পর্যন্ত (ভোট-পূর্ববর্তী) ১৬ হাজার ৫১০টি হয়। কিন্তু এখন গণশক্তি আসছে মাত্রই ৫ হাজার ৩৮৫টি। নানা এলাকায় নতুন শাসকদলের ‘সন্ত্রাসে’ই এই পরিস্থিতি বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হলেও, সংখ্যা-হ্রাস সমর্থন-হ্রাসেরও ইঙ্গিত বলে মানছেন ওই নেতারা।
সিপিএম জেলা সম্পাদক অবশ্য ‘সন্ত্রাসে’র সংখ্যাতত্ত্বও দিয়েছেন প্রতিবেদনে। নির্বাচনী ফল ঘোষণার পর থেকে জেলায় ৭ জন নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন, ৮২৩ জন প্রহৃত হয়েছেন, ৪৫ জন ‘অপহৃত’ হয়েছেন, ‘মিথ্যা মামলা’য় ২৮৯ জন গ্রেফতার হয়েছেন, তিন হাজারের বেশি সমর্থককে হুমকি দিয়ে শিবির-বদল করতে বাধ্য করা হয়েছে, অত্যাচার সইতে না পেরে আত্মঘাতী হয়েছেন এক জন, ৫-৬ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে এবং ১৬ হাজার বামপন্থী কর্মী-সমর্থক ঘরছাড়া হয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে। এর মধ্যেও অবশ্য ‘আশার কথা’ হিসাবে জেলা সম্পাদক জানিয়েছেন, আগের সম্মেলনের সময়কার ২৯৫৯ থেকে বেড়ে ২০১১-এর পুনর্নবীকরণের সময়ে জেলায় দলের শাখা-কমিটির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১৬৫। লোকাল কমিটির সংখ্যা ১৭৮ থেকে বেড়ে ১৮৩। এবং জোনাল কমিটির সংখ্যা ২৮ থেকে বেড়ে ৩৩ হয়েছে। ‘প্রতিকূল’ পরিস্থিতিতেও পার্টি সদস্যদের কাছে ‘আত্মপ্রত্যয়ে ভরপুর হয়ে সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে চলা’রই ডাক দিয়েছেন জেলা সম্পাদক। ‘প্রতিকূলতার মধ্যেই সম্ভাবনার উপাদানগুলিকে কাজে লাগিয়ে জনভিত্তি বাড়ানো’র কথাও বলেছেন দীপকবাবু।
কিন্তু এই ‘আশাবাদ’ নিয়ে ‘এগোনো’র বদলে সম্মেলনের পরে-পরেই নতুন জেলা-কমিটি নিয়ে দলের ভিতরেই শুরু হয়েছে চাপানউতোর। নানা কারণে জোনাল সম্পাদকের পদ থেকে ‘অপসৃত’, এমনকী জোনাল কমিটির সদস্যও করা হয়নি-এমন নেতাকে (মিহির পাহাড়ি) কমিটিতে রাখা হলেও কয়েক জন নতুন জোনাল সম্পাদককে কমিটিতে রাখা হয়নি। যেমন, মেদিনীপুর পূর্ব জোনাল কমিটির সম্পাদক নিরঞ্জন মাইতি, মেদিনীপুর পশ্চিম জোনাল কমিটির সম্পাদক দেবাশিস দত্ত, ডেবরা জোনাল কমিটির সম্পাদক প্রাণকৃষ্ণ মণ্ডল জেলা কমিটিতে ঠাঁই পাননি। যা সিপিএমের মতো দলে বিস্ময় তৈরি করেছে। আবার মেদিনীপুর থেকে নতুন প্রজন্মের কারও বদলে প্রবীণা আরতি বসুর জেলা কমিটিতে ঠাঁই নিয়েও জেলা সম্পাদকের বিরুদ্ধে কমিটিতে ‘পরিকল্পনামাফিক’ ঘনিষ্ঠদের সংখ্যা বাড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। |
|
|
 |
|
|