প্রবন্ধ ২...
সলমন রুশদি নিয়ে ওঁদের কোনও মাথাব্যথা নেই
সাতসকালে খুঁজে পেতে একটা বাসী কাগজে সলমন রুশদির ভারত আগমন সংক্রান্ত বাদানুবাদে চোখ বুলোচ্ছি। মুসলমানদের ‘রক্ষণশীলতা’ মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত, প্রগতি-বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত গোটা জনগোষ্ঠী। এমন সময় কানের কাছে ঝলকে উঠল নারীকণ্ঠ: ‘তাড়াতাড়ি করো সব, এখনই ক্লাস শুরু হবে।’ চোখে চোখ পড়তেই এক জন বলে উঠল, ‘দেখছেন দিদি, আমরা সেই কখন স্নানটান সেরে তৈরি হয়ে আছি, ছেলেগুলোর এখনও হল না।’ একদল প্রাণবন্ত মুসলিম তরুণী এবং এক জন আদিবাসী এসেছেন বহরমপুরে চার দিনের এক নতুন ধরনের প্রশিক্ষণ শিবিরে। রাজ্য জুড়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থান নিয়ে একটি প্রাথমিক তথ্য-ভিত্তিক পাবলিক রিপোর্ট তৈরির প্রক্রিয়ায় এই শিবির, যেখানে এসেছেন বিভিন্ন জেলার সমাজকর্মীরা, পুরুষ ও নারী সমান সংখ্যায়।
দেশ জুড়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীর অবস্থা নিয়ে প্রকাশিত সাচার কমিটি-র রিপোর্ট বেরোবার পর তদানীন্তন রাজ্য সরকার সেই রিপোর্টটিকে যথাযথ বলে মনে করেনি। রাজ্যবাসীকে জানানো হয়েছিল, সে রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠেনি। আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছিল, রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি উচ্চ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এ সংক্রান্ত রিপোর্ট তৈরি করতে বলা হয়েছে। মাস বছর পেরিয়ে গেলেও সে রিপোর্টের দেখা মেলে না। অবশেষে তথ্যের অধিকার আইনে দরখাস্ত করে জানা গেল, এমন কোনও সমীক্ষা হওয়া তো দূরস্থান, সরকারি ভাবে সেটা ‘কমিশন’ই করা হয়নি।
রাজ্যে মুসলিম জনগোষ্ঠী নিয়ে বিতর্ক চললেও এ ব্যাপারে সাধারণের নাগালে পৌঁছবার মতো বিশেষ কোনও কাজ নজরে পড়েনি, দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া। সে অভাব দূর করতে কয়েক জন ব্যক্তির উদ্যোগে একটি পাবলিক রিপোর্ট বা গণ-প্রতিবেদনের আয়োজনে লেগেছেন। জাহাঙ্গির হোসেন ও সাবির আহমেদ কাজটির অন্যতম উদ্যোক্তা, কিন্তু এঁদের সঙ্গে আছেন মুসলমান-হিন্দু নির্বিশেষে বেশ কিছু বিদ্যানুশীলক, সমাজকর্মী ও অন্যরা। প্রাতিষ্ঠানিক কোনও সাহায্য ছাড়া শুধু শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতায় এঁরা কাজটা শুরু করেছেন।
এমনই এক শুভানুধ্যায়ী দিলরুবা সরকার। স্ব-রোজগার দলের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালান বহরমপুরে। কেন্দ্রের নাম ‘অ্যারিনা’। জেলার স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কয়েক লক্ষ মহিলার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ। তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করে চলেছেন নানা সামাজিক বিষয়ে। (উল্লেখ্য, স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি রাজ্য জুড়ে মেয়েদের ক্ষমতায়নের যে কাজ করে চলেছে, রাজ্যের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তা হয়তো অনেক কিছু যোগ করতে পারে।) তাঁরই কেন্দ্রে সমীক্ষার প্রশিক্ষণ হল।
সাধারণ অভিজ্ঞতা বলে, এই ধরনের সমীক্ষার কাজে মেয়েদের খুব একটা পাওয়া যায় না। যাঁরা আসেন, তাঁরা পেশাগত ডিগ্রিধারী, সমাজের ‘এগিয়ে থাকা অংশের মানুষ’। এখানে দেখা গেল, পুরুষের সমান সংখ্যায় মেয়েরাও এসেছেন। এঁদের প্রায় সকলেই প্রথম এই ধরনের কাজে এলেন, বেশির ভাগই দূরদূরান্তের গ্রাম থেকে। সেটাই হয়তো কারণ যে, প্রশিক্ষণটি চালানো হল চার দিন ধরে সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। এবং আশ্চর্য, কারও কোনও ক্লান্তি, বিরক্তি বা অমনোযোগ দেখা গেল না। এঁদের ভিন্ন ভিন্ন পারিবারিক অবস্থান ও দায়িত্ব, এ কাজটাতে আর্থিক লাভ তাঁদের নেই। এঁদের একমাত্র উৎসাহ ইনসেনটিভ পশ্চিমবঙ্গের এই বৃহত্তম জনগোষ্ঠীটি সম্পর্কে বিশদে ও গভীরে জানা এবং বৃহত্তর রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে তুলে ধরা যে সমাজ ও রাষ্ট্র বার বার গোষ্ঠীর দোহাই দিয়ে তাঁদের দূরে ঠেলে রাখে, তাঁদের নির্ণায়ক ভূমিকা থেকে বঞ্চিত রাখে।
সলমন রুশদির ভারতে আসা, বা মকবুল ফিদা হুসেনের স্বদেশে ফেরা এই ধরনের প্রস্তাবনার ক্ষেত্রে বরাবরই দেখা যাচ্ছে সেকুলার ভারত রাষ্ট্র বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিশেষ একটি এবং প্রায়ই ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ অংশের মতামতকেই প্রধান বলে তুলে ধরে। এমন একটি ছবি আঁকা হয়, যেন একমাত্র ওই অংশটিই সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর একমাত্র প্রতিনিধি, এবং তাদের ভাল-লাগা, মন্দ লাগার সামান্য আঁচটুকু এলেই রাষ্ট্রকে তার মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি সংকুচিত করতে হবে, বিসর্জন দিতে হবে। এই মতামতগুলি গোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশের ভাবনা কি না, অথবা এ ধরনের সাংস্কৃতিক সমস্যা নিয়ে আদৌ তাদের কোনও মাথাব্যথা আছে কি না, সে প্রসঙ্গটা তোলাই হয় না। ফলে কোনও কোনও বিশেষ গোষ্ঠীকে সংকীর্ণ, ধর্মান্ধ, অবৈজ্ঞানিক, সহিংস, ইত্যাদি সংজ্ঞার খোপে পুরে দেওয়া হয়। এ থেকে যে অবধারণা তৈরি করা যায়, তা হল, সেই গোষ্ঠীর যাবতীয় পশ্চাদপদতার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী, দায়ী তাদের গোঁড়া, কোটরায়িত পরিচিতি। অতএব, রাষ্ট্রের দায়িত্ব লঘু হয়ে যায়, সমাজ হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।
কিন্তু এর পরিণতিতে যে গোষ্ঠীগুলো বঞ্চিত থেকে যায়, তাদের মধ্যে আবার মেয়েরা হন দ্বিগুণ বঞ্চনার শিকার। তাঁদের কাছে মৌলিক যে সুযোগসুবিধাগুলো পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি, তা থমকে যায়। আবার তাঁদের উপর যে নিত্যদিনের বঞ্চনা ও অত্যাচার ঘটে, আদতে যেগুলি ফৌজদারি অপরাধ, সেগুলিকেও ধর্মীয় হিসেবে চিহ্নিত করে ন্যায়ের হাত বেঁধে দেওয়া হয়। এই মেয়েরা ঠিক কী ভাবেন, রাষ্ট্র ও তার মূলস্রোত সে কথা শুনতে চায় না। এঁদেরও সেই ক্ষমতায়ন ঘটেনি, যাতে তাঁরা নিজেদের কথা শোনাতে পারেন।
মুর্শিদাবাদের এই প্রশিক্ষণ শিবির কিন্তু শোনাল অন্য এক কাহিনি। এখানে সলমন রুশদি নিয়ে কেউ আলোচনা করছে না, কেউ চর্চা করছে না হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় অন্তর নিয়ে। ধর্মীয় পরিচিতির বাইরে এঁরা এসেছেন অন্য এক নিজস্ব পরিচয়ে। পারিবারিক পুরুষতন্ত্র তাঁদের কাছে বাধা হয়ে ওঠেনি। বৃহত্তর মানবী পরিচিতির দিকে তাঁদের অগ্রসরতা হয়তো পুরুষতন্ত্রকেও প্রভাবিত করেছে। এখানে এমন এক পরিসরে তাঁরা যুক্ত হচ্ছেন, যেটি বৃহত্তর সমাজকল্যাণের ক্ষেত্র। সমীক্ষার বিষয়বস্তু, মুসলমানদের অবস্থা নিয়ে যেমন চুলচেরা আলোচনা হল বার বার কেউ না কেউ উঠে বলছিলেন, ‘আমার একটা প্রশ্ন আছে’, তেমনই কথায় কথায় উঠে এল মেয়েদের অবস্থান, তাঁদের উচ্চ শিক্ষা, শরীর ও প্রজনন সমস্যা, জন্মনিয়ন্ত্রণ ও সরকারি অবহেলার কথা। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তাঁদের মতামতকে পরিপুষ্ট করছে। জীবনের যে দুস্তর পথ তাঁরা হেঁটে আসছেন, সেখানে তাঁদের প্রতি মুহূর্তে লড়তে হয় ন্যূনতম সুযোগগুলোর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মনিয়োজনের জন্য। পাশাপাশি আছে পারিবারিক দায়িত্ব: শিশু ও বড়দের দেখাশোনা। এরই মধ্যে তাঁরা এসেছেন বাসে, ট্রেকারে চেপে। এ সবই তাঁদের দিয়েছে এক ধরনের ঋজুত্ব। এঁরা অন্য মাত্রায় সম্পন্ন। এঁদের আগ্রহ অসীম শেখার, জানার, কাজ করার। সলমন রুশদি নিয়ে বিড়ম্বিত হওয়ার চেয়ে এঁদের এই আগ্রহ ও জীবনীশক্তিতে কথা হওয়া অনেক বেশি বাঞ্ছনীয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.