প্রবন্ধ ১...
শুধু সরকারি সাহায্যে কৃষির সমস্যা মিটবে না
কৃষকেরা তাঁদের পণ্যের পর্যাপ্ত দাম না পেলে আত্মহত্যা করেন এ কথা এ দেশে খুব শোনা যায়। কৃষকের আত্মহত্যাও কঠোর বাস্তব। কিন্তু প্রশ্ন হল, ঠিক দাম পাওয়া এত শক্ত হয় কেন? সব দায় রাজ্য সরকারের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সহজ, কিন্তু কৃষিতে অনুসৃত কিছু বুনিয়াদি নীতির বুনিয়াদি গোলযোগ এবং অনেক আপাত-জনপ্রিয় নীতির বিধ্বংসী প্রভাব থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারি কি আমরা? ‘গরিব মানুষ’ ও ‘দরিদ্র চাষি’দের স্বার্থরক্ষাকারী নীতি-সমূহের মধ্যে এক ধরনের সংঘাত এড়ানো সব সময় সম্ভব হয় না। ব্যাপারটা বিচার করা দরকার।
প্রথম কথা, সরকারি সহায়তা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সমাধান করতে পারে না। সমস্যাটির মূল চরিত্র নিয়ে আলোচনা না হলে সরকারি সাহায্য বলতেই ভর্তুকি এসে পড়ে। সরকারি বিজ্ঞাপনে বলা হয়, চাষিকে শস্য উৎপাদনের জন্য ভর্তুকি দিয়ে এবং শস্য বিক্রির সময় বেশি দাম দিয়ে সরকার তাঁদের জন্য বিরাট কাজ করছেন। সেই ভর্তুকি কোথা থেকে আসবে, সে প্রসঙ্গে না গিয়েও বলা যায় যে, আসলে ভর্তুকি ছাড়া কৃষি উৎপাদন সম্ভব নয়। সেটাই বড় সমস্যা, সেটাই রোগ। দিনের পর দিন এক দিকে সারে ভর্তুকি দিয়ে চললে এবং অন্য দিকে বাজার-বহির্ভূত ‘ন্যায্য’ দাম ঠিক করে সমস্যার মূলকে এড়িয়ে গেলে এক দিন না এক দিন সে সমস্যা মাথা চাড়া দেবেই। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তা-ই হচ্ছে। দীর্ঘ কাল ধরে দামি অজৈব সারের ওপর ভর্তুকি দিয়ে আমাদের চাষকে বিদেশ থেকে আমদানির ওপর নির্ভরশীল করে তোলা হয়েছে। আজও জৈব সারের ব্যাপক উৎপাদন ও ব্যবহারের জন্য কোনও সরকারি নীতি প্রযুক্ত হয়নি।
এ বার বলি অন্য একটা নীতিগত সমস্যার কথা। খাদ্য সুরক্ষা আইন এবং জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পের মতো পদক্ষেপের ফলে গ্রামের মানুষের উপকার হবে এ কথা সুপরিচিত। কিন্তু এর ফলে দরিদ্র চাষিদের কতটা উন্নতি হবে, সে কথা বলা শক্ত। বস্তুত, যাঁরা ছোট ছোট জোতে চাষবাস করেন, ওই সব নীতির ফলে তাঁদের ক্ষতির কথা অস্বীকার করা যায় না। কেন এ কথা বলছি, সেটা বোঝার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের জনমুখী অর্থনীতির এই বিশেষ দুই প্রকল্পের কিছু পর্যালোচনা বাঞ্ছনীয়।
গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনার ফলে চাষের মজুরিগত ব্যয় অত্যন্ত বেড়ে গিয়েছে। ‘দরিদ্র চাষি’ দিনমজুরের ওপর ভীষণ ভাবে নির্ভরশীল। তাই কর্মসংস্থান যোজনার ফলে এ রাজ্যে এবং অন্যত্র ক্ষুদ্র চাষিদের খুব সমস্যা দেখা দিয়েছে। কোন দরিদ্রকে তবে দেখছেন সরকার? এটা বোঝা উচিত যে, দরিদ্র মজুর এবং দরিদ্র ক্ষুদ্র চাষির এক সঙ্গে উন্নতিসাধনের একমাত্র উপায় কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, এ দেশে যে উৎপাদনশীলতা বিশ্বের তুলনায় অনেক কম।
আপনি অনেক খরচ করে শস্য উৎপাদন করলেন, কেন করলেন? বাজারে বিক্রি করে ভাল দাম পাবেন বলে। পেলেন না। কেন পেলেন না? প্রচুর শস্য উৎপাদনের ফলে বাজারে দাম কমে যেতে পারে। তার চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার, আপনার শস্য বন্যায় বা খরায় নষ্ট হতে পারে। প্রশ্ন হল, সারে ভর্তুকি এবং সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম দাম ছাড়া যদি শস্য উৎপাদন মুনাফা-উপযোগী না হয়, তা হলে মূল সমস্যাটা কখনও ন্যূনতম দাম বা ভর্তুকির ব্যাপার হতে পারে না। শস্য উৎপাদন সব জায়গায় ক্ষতিকর, তা-ও নয়। আবার ন্যূনতম দাম চাষি যাতে ঠিক মতো পান, সেই ব্যবস্থা ঠিকঠাক করাও জরুরি। কিন্তু সমস্যা হল, কৃষিজাত পণ্য বা খাদ্যশস্যের আসল অর্থনীতিটা বলিষ্ঠ না দুর্বল, সেটা ভাল ভাবে জানা চাই।
খাদ্য সুরক্ষা বিল নিয়ে মাতামাতি করছি আমরা। দু’সপ্তাহ আগে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার প্রত্যন্ত একটি জায়গায় এক জন অত্যন্ত অভিজ্ঞ, শিক্ষিত কৃষক ‘বন্ধু’র সঙ্গে গল্প হচ্ছিল। তিনি বললেন, লোকে যদি দু’টাকা কিলো চাল পায়, তা হলে বাজার থেকে চাল কিনবে কেন? ব্যাপারটা ভেবে দেখা প্রয়োজন। পাশাপাশি, আমরা বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানতে পারছি, দারিদ্র-সীমারেখার নীচের মানুষদের জন্য বরাদ্দ শস্য, কাজ, ভর্তুকি অনেক সময়ই তাঁদের কাছে পৌঁছয় না। অনেক ক্ষেত্রে শতকরা পঞ্চাশ ভাগের বেশি অন্যদের পকেটে গিয়ে ঢোকে। তা হলে, যদি দু’টাকার চাল দরিদ্রদের বদলে অন্য কেউ পেয়ে যায়, তারা তো আর চাষিদের কাছে তা কিনবে না। অনেক চাল বিক্রেতাই দরিদ্র চাষি। ফলে বাজারে শস্যের দাম আরও কমবে আর দরিদ্র চাষিদের প্রতি অন্যায় হবে। অন্য দিকে, নেপোয় মারে দই-এর মতো এর সুবিধা ভোগ করবেন অপেক্ষাকৃত সচ্ছল মানুষেরা, কারণ ওই দরিদ্র চাষিদের অনেকেই ন্যূনতম দাম পাওয়ার জন্য সরকারি সংগ্রহ কেন্দ্রে পৌঁছতে পারবেন না। দরিদ্র চাষিরা কেন দরিদ্র, শস্যের উৎপাদন কেন মুনাফা দিতে পারে না, কেন সারের দাম এত বেশি, কেন জৈব সারের প্রসার ঘটে না, কেন এত শস্য নষ্ট হয়, কেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ বা কুফল আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হবে।
এ রাজ্যে শস্য উৎপাদন বাম আমলে কিছু সময়ের জন্য নিশ্চয়ই বেড়েছিল। কেন বেড়েছিল, তা নিয়ে ধন্দের শেষ নেই। মাটির নীচে জলভাণ্ডার অবিরাম শোষণ করে, ছোট ছোট পাম্প-সেট বসানোর ঢালাও অনুমতি দিয়ে শস্য উৎপাদন বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু ঢাক-ঢোল পিটিয়ে অনেকে সেটাকে ভূমি সংস্কারের অবদান বলে চালাতে চেয়েছেন। ভূমি সংস্কারের এক বিশাল ত্রুটির দিক নিয়ে প্রচুর আলোচনা প্রয়োজন। ছোট মানেই সুন্দর, এ রকম একটা ভ্রান্ত ধারণা আমাদের মজ্জাগত। জমিকে ভাগ করে করে প্রচুর মালিক তৈরি করে হয়তো সাম্য প্রতিষ্ঠা করা যায়, দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদন ও দক্ষতা বাড়ানো যায় না। জোতের একটা ন্যূনতম আয়তন ভীষণ ভাবে প্রয়োজন, তা না হলে কৃষিতে লাভজনক বিনিয়োগ করা যায় না। ঢালাও ভর্তুকি, ন্যূনতম দাম ও বাজার-দামের প্রভূত ফারাক, অঢেল কৃষিঋণের ব্যবস্থা কেন এত দিনেও ভারতীয় কৃষিকে যথেষ্ট উৎপাদনশীল কৃষিব্যবস্থায় পরিণত করতে পারেনি? ভূমি সংস্কারের ফলে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হয়ে যাওয়া জোতগুলোকে কোনও ভাবে একত্র করতে না পারলে মুক্তি নেই। সমবায়ের ভিত্তিতে হোক, বেসরকারি উদ্যোগ বা অন্য ধরনের সরকারি উদ্যোগের ভিত্তিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জোতকে সংঘবদ্ধ করতেই হবে।
এ রাজ্যে চুক্তি-চাষ প্রয়োজন, ভীষণ ভাবে প্রয়োজন। এ কথা অনেক দিন ধরে বলে আসা হয়েছে। সেখানেও যূথবদ্ধ জোতের প্রয়োজন। বেসরকারি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে পঞ্চায়েতের ভূমিকা, সরকারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু চুক্তিবদ্ধ চাষে দাম আগেই নির্ধারিত হয়ে যায়, ঝুঁকি কমে। এ কথা ঠিক যে, বাইরের বাজারে যে পণ্যের চাহিদা বেশি, সেই পণ্যই বেশি উৎপাদন হলে পর্যাপ্ত চাল-গম উৎপাদন হবে কি না সংশয় থেকে যায়। সে জন্য চুক্তি-চাষ নিয়ন্ত্রণ করা যেতেই পারে। কিন্তু সাধারণ ভাবে, রাজ্যের চাষ ব্যবস্থাকে বাজারমুখী করার বিশেষ প্রয়োজন। কৃষিপণ্য বিপণন ও সংগ্রহের ব্যাপারে রাজ্য সরকার কিছু বিশেষ ব্যবস্থা করছে, মধ্যস্বত্বভোগীরা যাতে চাষির লাভের বড় অংশ না পেয়ে যান।
কৃষক আত্মহত্যা প্রসঙ্গে সবচেয়ে কথিত এবং আলোচিত কারণ হল ঋণ শোধ দিতে না পারা। আবার বলি, যে কোনও আত্মহত্যাই খুবই দুঃখের। বিশেষ করে যে পরিবারের ক্ষতি হয়ে গেল, তাদের কথা ভাবলে যে কোনও মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষই শোকস্তব্ধ হয়ে পড়বেন। কত কষ্ট করে শস্য ফলান কৃষকেরা, কত অনিশ্চয়তা সঙ্গে নিয়ে, জীবন দিয়েও হয়তো তা রক্ষা করার চেষ্টা করেন! তবুও, কৃষক-আত্মহত্যা নিয়ে যে রকম আলোচনা সংবাদমাধ্যমে হচ্ছে, সে সম্পর্কে কিছু বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া প্রয়োজন। কতগুলো প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন।
সব আত্মহত্যাই কি চাষে সরকার-দেয় ন্যূনতম দাম না পাওয়ার জন্য?
যদি ন্যূনতম দাম পেয়েও আত্মহত্যার কারণ ঘটে তা হলে কি বুঝতে হবে, কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করে ন্যূনতম দাম ধার্য করেনি?
আত্মহত্যার পিছনে ব্যক্তিগত ভুল পরিকল্পনা কতটা দায়ী? অত্যধিক ঋণ নিয়ে ফেলা কি যুক্তিগ্রাহ্য ছিল? কেউ যেন অতিরিক্ত ঋণ নিতে না পারেন, সরকারের কি সেই ব্যবস্থা করা উচিত? তবে সরকার বেশি বেশি কৃষিঋণ না দিলে এত সমালোচনা হয় কেন?
ধার শোধ দিতে না পারলে সেই ধার আমার পরিবারের উপর চেপে বসে কি? যদি চেপে না বসে, তা হলে আমার আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়বে। পরিবারের যাঁরা পড়ে রইলেন, ঋণের দায় যদি তাঁদের ঘাড়ে পড়ে, তা হলে আমি দু’বার ভাবব। অর্থনীতির যুক্তি শয়তানের উকিলের মতো শোনায়, কিন্তু তাকে অগ্রাহ্য করা শক্ত।
খবরে প্রকাশ, কৃষক শস্যের ঠিক দাম না পাওয়ায় ধার শোধের কিস্তির জন্য স্ত্রীর গয়না বন্ধক রাখতে চান। স্ত্রী আপত্তি করলে কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করেন। দায় কার?
ঘটনা হল, শস্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে খানিকটা বাজারোপযোগী করতেই হবে। উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে, যূথবদ্ধ জোতের ভিত্তিতে চুক্তিচাষ দিয়ে, কৃষিতে পরিকাঠামো জল সেচে বিনিয়োগ করে, উৎপাদনশীলতা বাড়াতেই হবে। কোনও ভর্তুকি ছাড়া একশো টাকা খরচ করে শস্য উৎপাদন করলে কোনও সাহায্য ছাড়া একশো টাকার চেয়ে খানিকটা বেশি রোজগার হতেই হবে। দামের নিশ্চয়তা বাড়াতে হবে যাতে বড় বড় সংস্থা আগেভাগেই দাম দিয়ে শস্য কেনেন। মধ্যস্বত্বভোগীদের আওতা থেকে কৃষকদের বাঁচানোর ব্যবস্থা চাই। কৃষিপণ্যের বিক্রিতে বেসরকারি বিনিয়োগ ও অংশীদারি আরও বাড়াতে হবে। এ ছাড়া দীঘর্মেয়াদি সমাধানের অন্য কোনও পথ নেই। ভর্তুকি বা ন্যূনতম দাম রাজনীতির পাইয়ে দেওয়ার ক্ষমতাকে পুষ্ট করে, কৃষির মূল সমস্যাকে আঘাত করে না।

অর্থনীতিবিদ, কলকাতায় সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এর অধিকর্তা। মতামত ব্যক্তিগত


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.