বারবার তিন বার। তিন বারই ফাইল লোপাট হল খাস স্বাস্থ্য ভবন থেকে। তিন বারই সংশ্লিষ্ট কর্তারা জানালেন, বিষয়টা তাঁরা শুনেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ফাইল তালেগোলে কোথায় গিয়ে পড়েছে, তা তাঁদের জানা নেই। উদ্যোগের এমন পরিণতিতে হতাশ চিকিৎসকেরা এ বার গোটা বিষয়টিতেই দাঁড়ি টানতে চলেছেন। আর এই গোটা বিষয়টি যে রোগকে ঘিরে, তার নাম ক্যানসার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হুঁশিয়ারি অনুযায়ী ২০২০ সালে যা এ দেশে মহামারীর আকার নেবে।
চিকিৎসকদের বক্তব্য, প্রতি বছর যত রোগী সরকারি হাসপাতালে আসেন, তাঁদের অনেককেই আরও কিছুটা উন্নত জীবন উপহার দেওয়া সম্ভব হত, যদি সরকারি পরিকাঠামোয় আরও উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকত। সেই উন্নত চিকিৎসার জন্য কী কী সরঞ্জাম প্রয়োজন, কোথায়, কী ভাবে সেগুলি বসাতে হবে, কেমন করে বর্তমান বিল্ডিংকেই খানিকটা অদলবদল করে সেই কাজ সম্ভব, কী ভাবে আরও বেশি সংখ্যক রোগীর কাছে পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া যায়, সেই সংক্রান্ত সবিস্তার একটি প্রকল্প এসএসকেএমের চিকিৎসকেরা তৈরি করেন। ২০০৯ সালের নভেম্বরে সেটি স্বাস্থ্য ভবনে জমা পড়ে। তার পরে সেই প্রকল্প-রিপোর্টের ভিত্তিতে বৈঠকও হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার পরে বিষয়টি আর এক চুলও এগোয়নি। এসএসকেএমের এক কর্তা বলেন, “খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারলাম, ফাইল হারিয়ে গিয়েছে। প্রথম বার কিছু মনে হয়নি। ফের ওই একই জিনিস তৈরি করে জমা দেওয়া হল। সে বারও একই অবস্থা। তখনই খুব ভেঙে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম আর জমা দেব না। কিন্তু তার পরে সরকার বদলের পরে ভেবেছিলাম পরিস্থিতি বদলাবে। অনেক আশা নিয়ে ফের ফাইল জমা দিলাম। কিন্তু এ বারেও একই অবস্থা।” অর্থাৎ, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে!
রাজ্যে প্রতি বছর প্রায় ৭০ হাজার নতুন ক্যানসার রোগীর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি হাসপাতালগুলিতেই গড়ে বছরে চার-পাঁচ হাজার রোগীর নাম নথিভুক্ত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। কারণ, বহু রোগীই হোমিওপ্যাথি বা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করান। অনেকে চিকিৎসার ন্যূনতম সুযোগও পান না। ফলে মূল ছবিটা আরও ভয়ঙ্কর। এই পরিস্থিতিতে ক্যানসারের আরও আধুনিক ও বেশি ফলদায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা সংক্রান্ত একটি প্রকল্প এসএসকেএমের রেডিওথেরাপি বিভাগ থেকে জমা পড়েছিল স্বাস্থ্য ভবনে। রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান অনুপ মজুমদার বলেন, “বেসরকারি হাসপাতালে রেডিয়েশন নিতে গেলে লাখ দেড়েক টাকা খরচ হয়। সেই সামর্থ্য খুব কম সংখ্যক মানুষেরই আছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে আধুনিক সরঞ্জাম না-থাকলে রোগীরা কখনওই আধুনিক চিকিৎসা পাবেন না। এসএসকেএমে লিনিয়র অ্যাক্সিলেরেটর যন্ত্র, আইএমআরটি, আইজিআরটি যন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছিল। এসএসকেএম যে হেতু সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল, তাই এ রাজ্যে বেসরকারি স্তরে এখনও যা নেই, সেই ‘সাইবার নাইফ’-এর চাহিদার কথাও লেখা হয়েছিল।” স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমি বিষয়টি জানি না। খোঁজ নেব। যত দ্রুত সম্ভব এ বিষয়ে এগোনোর চেষ্টা করা হবে।” ’৭৪ সালে এসএসকেএমে রেডিওথেরাপি বিভাগ চালুর পর থেকে প্রযুক্তিগত খুব বেশি উন্নতি হয়নি। বাড়েনি শয্যাও। কেমোথেরাপির ওষুধ যা প্রয়োজন, মেলে তার অর্ধেকেরও কম। দিনের পর দিন মুমূর্ষু রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এই পরিস্থিতিতে সরকারি স্তরে এমন নির্লিপ্তি রোগীদের অবস্থার কতটা পরিবর্তন ঘটাবে, সে বিষয়ে কেউই তেমন আশাবাদী নন।
তবে সরকারি উদাসীনতার নজির এই প্রথম নয়। নীলরতন সরকার হাসপাতালে তিন বছর আগে লিনিয়র অ্যাক্সিলেরেটর যন্ত্র বসানোর ঘোষণা হয়েছিল। কিন্তু ঘোষণাই সার। বিভাগীয় প্রধান সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “এখনও বিল্ডিং তৈরির কাজ চলছে। যন্ত্র কবে বসবে কেউ জানে না।” |