সে দিনের ‘অপরাধী’দের কঠোর শাস্তিই চান কল্পনা, কুন্তিদেবীরা
কটাই ঘটনা। অথচ রাজ্য প্রশাসনের দুই শীর্ষ ব্যক্তিত্বের প্রতিক্রিয়া ছিল একেবারেই দুই মেরুর। তদানীন্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধীর বিবৃতিতে ছিল ‘দীপাবলির আলো, আনন্দ ম্লান’ হয়ে যাওয়ার বেদনাবোধ। আর তখনকার মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, “দে হ্যাভ বিন পেড ব্যাক ইন দিয়ার ওন কয়েন’ (ঢিলের বদলে পাটকেল খেয়েছে)! আর বিমান বসু, শ্যামল চক্রবর্তীর মতো সিপিএমের শীর্ষ নেতারা বলেছিলেন, “নন্দীগ্রামে সূর্যোদয় হয়েছে!”
মুখ্যমন্ত্রী তথা শাসকদলের নেতৃত্বের এই মনোভাবেই ‘বিচারের’ সব আশা ছেড়েছিলেন ‘নিখোঁজ’ আদিত্য বেরা, সুবল মাজি, নারায়ণ দাস, সত্যেন গোল, বলরাম সিংহ, ভগীরথ মাইতি-র পরিজনেরা। বাম সরকারের পুলিশ চার বছরেও ‘নিখোঁজ’দের ব্যাপারে যে কিছু জানাতে পারেনিতাতেও তাই বিস্মিত হন না প্রাক্তন সেনাকর্মী আদিত্য-র অশীতিপর কাকিমা কুন্তি বেরা বা জনমজুর ভগীরথের স্ত্রী সুষমা মাইতি। রাজ্যে পালাবদলের সুযোগে বিচারের আশা নিয়ে ওঁরা দ্বারস্থ হয়েছিলেন হাইকোর্টের। সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। বাম-আমলে জেলা পুলিশ চার বছরেও যা পারেনি, সাড়ে তিন মাসে সে কাজটাই করল সিআইডি। ২০০৭-এর ১০ নভেম্বর ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির মিছিলে গিয়ে আদিত্য বেরাদের মতো কয়েক জনের ‘নিখোঁজ’ হওয়া সংক্রান্ত মামলায় সোমবার হলদিয়া আদালতে সিআইডি-র চার্জশিটের পরে বিচারের আশাটাকে আরও আঁকড়ে ধরতে চাইছেন নন্দীগ্রামের স্বজনহারারা।
হলদিয়া আদালত চত্বরে নন্দীগ্রাম-কাণ্ডে ধৃত
কাকিমা কুন্তিদেবী সন্তানস্নেহে মানুষ করেছিলেন আদিত্যকে। সেই ছেলে সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। ঝুঁকির জীবন পেরিয়ে অবসর নিয়ে ঘরে ফিরেছিলেন। সেই তাঁকেই গ্রামের গণ্ডগোলে চিরতরে হারাতে হবেআজও বিশ্বাস করতে পারেন না তাঁর কাকিমা। ২০০৭-এর জমিরক্ষার আন্দোলনের সময়ে আদিত্যবাবুর বয়স তখন ৫৮। নভেম্বরের গোড়ার দিক থেকেই সিপিএমের ‘সশস্ত্র বাহিনী’ নন্দীগ্রাম ঘিরতে শুরু করে বলে অভিযোগ। আদিত্যবাবুর পুত্রবধূ শ্যামলী বেরা বলেন, “৬ নভেম্বর থেকেই আমাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। উনি সাউদখালিতে আত্মীয়বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১০ তারিখের মিছিলে অবশ্য ছিলেন সামনের সারিতেই। মিছিলের অন্যদের থেকে শুনেছি, ওরা গুলি করেছিল। উনি লুটিয়ে পড়েছিলেন। তার পর ওরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল খেজুরির দিকে।” প্রতিবন্ধী ভাই প্রশান্ত বলেন, “সিপিএমের শিবিরে গিয়েও খোঁজ করেছি। ওরা কানেই নেয়নি আমাদের কথা।” আর কুন্তিদেবীর আক্ষেপ, “যদি মেরে দিয়েই থাকে জানাতে তো পারত!”
মিছিলে গিয়ে যাঁরা নিখোঁজ

সে দিন গুলিবিদ্ধ কল্পনা মুনিয়ান

ভগীরথ মাইতি

সত্যেন গোল

সুবল মাজি

নারায়ণ দাস

বলরাম সিংহ
সোনাচূড়ার বছর চল্লিশের সুবল মাজি জনমজুরি করতেন। ১০ নভেম্বর সকালে মুড়ি খেয়ে সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন আর ফেরেননি। স্ত্রী কৃষ্ণা বলেন, “দুপুরে খবর পেয়েছিলাম মিছিল থেকে ওঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছে সিপিএমের লোকজন। পুলিশের কাছে গেলাম। খোঁজখবর পেলাম না। পরের দিন বাড়ির পাশ দিয়ে সিপিএম যখন ফের মিছিল করল, ওদের গিয়েও কত অনুনয় করলাম। কোনও কথাই শুনল না।” সুবলবাবুর বছর তেরোর ছেলে রাজুর প্রশ্ন, “ওরা আমার বাবাকে যদি ফিরিয়েই দিতে না পারে কড়া সাজা হোক।” সোনাচূড়ার বছর ষাটের নারায়ণ দাসও মিছিলে গিয়ে ফেরেননি। “অনেক জায়গায় গিয়ে, অনেকের হাতে-পায়ে ধরেও খোঁজ পাইনি”, মঙ্গলবার কাঁদতে-কাঁদতে জানালেন স্ত্রী সজলবালা। তাঁরও দাবি, “নৃশংস ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।” সাউদখালির ভ্যানচালক বছর চল্লিশের সত্যেন গোলও নিখোঁজ সেই থেকে। তাঁর স্ত্রী দুর্গা গোল বলেন, “এই সাড়ে চার বছর ধরে আমাদের যে যন্ত্রণা সইতে হয়েছে, তা খানিক জুড়োতে পারে একমাত্র দোষীদের কঠোর শাস্তি হলেই।” সত্যেনবাবুর ছেলে তপন নিজেও ছিলেন ভূমি-কমিটির সে দিনের মিছিলে। দেখেছিলেন বাবাকে গুলি খেয়ে মাটিতে পড়ে যেতে। সাউদখালির বছর আঠাশের জনমজুর বলরাম সিংহ, সাউদখালিরই বছর তেত্রিশের জনমজুর ভগীরথও চিরতরে হারিয়ে গিয়েছেন। বলরামের ভ্রাতৃবধূ মিতা, ভগীরথের স্ত্রী সুষমা বলেন, “যারা রক্তের হোলি খেলল, কঠোর শাস্তি হোক তাদের।”
আদিত্য বেরার ছবি নিয়ে কাকিমা কুন্তিদেবী।
আর সেই কল্পনা মুনিয়ান। গাঙড়ার সেই আশি ছুঁই-ছুঁই বৃদ্ধা। পেটে, পায়ে, হাতে গুলি লেগেছিল। পলিথিনে ঢেকে ভ্যান রিকশায় চাপিয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল খেজুরি। তারপর তপন-সুকুরদের গাড়িতে এগরায় উদ্ধার। আজও হাড় হিম হয়ে আসে বৃ্দ্ধার। বিচার চান।

ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.