গোল করতে গিয়ে গোল খেলেন ইস্টবেঙ্গল গোলকিপার
পাগলামি আর আজব পরিকল্পনা
প্রয়াগ ইউনাইটেড-১ (ভিনসেন্ট)
ইস্টবেঙ্গল-০
পা দু’টুকরো। এক গোলকিপার বাইপাসের ধারের হাসপাতালে বিষণ্ণ একাকী শুয়ে। মঙ্গলবারই তো অস্ত্রোপচার হল!
বাতিল অভ্র মণ্ডলের চোখের জল ইস্টবেঙ্গলের বাকি গোলকিপারদের বোধশক্তি মাঝেমাঝে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে নাকি? এ বারই কত উদাহরণ।
—মোহনবাগান ম্যাচে সন্দীপ নন্দীর হাত ফস্কে বল ঢুকে যায়। — এরিয়ান ম্যাচে দেবজিৎ মজুমদার জঘন্য গোল হজম করেন। — এয়ার ইন্ডিয়া ম্যাচে গুরপ্রীত বিশ্রী গোল খান। — ফেড কাপ ফাইনালে হার সন্দীপের ভুল জাজমেন্টে।
গোলকিপারদের ভুল এখন আকছার দেখা যায় টিভির কল্যাণে। কাসিয়াস, বুঁফো, দি জিয়াও বুদ্ধির অগম্য গোল হজম করেন নিয়মিত। বিশ্বকাপে কান, পম্পিদু, শুমাখার, হিগুইতা, সীমানের গোল হজমের দৃশ্য বলে দেয়, কেউ অতিমানব নন।
প্রয়াগ ইউনাইটেড ম্যাচে ইস্টবেঙ্গল গোলকিপারের ভুল সব কিছু ছাপিয়ে ইতিহাসের পাতায় ঢুকে পড়ল। কলকাতা ইদানীং এত অদ্ভুত নাটকীয় গোল দেখেনি।
ইনজুরি টাইমের খেলা তখন। কর্নার পেয়েছে ইস্টবেঙ্গল। হঠাৎই দেখা গেল, ছয় ফুট চার ইঞ্চির গোলকিপার গুরপ্রীত সিংহ সাধু প্রবল উৎসাহে দৌড়চ্ছেন প্রয়াগ বক্সের দিকে। আর একটা চিলাভার্ট, হিগুইতা বা রজারিও সেনি-র মতো স্কোরার-কিপার এল নাকি ইস্টবেঙ্গলে?
সৌমিক দে তাঁকে বাধা দিচ্ছিলেন অত উপরে যেতে। গুরপ্রীত শুনলে তো! বিশ্রী কর্নারের ক্লিয়ারিংয়ে বল পেয়ে প্রয়াগ বক্স থেকে দৌড় শুরু করলেন কেন ভিনসেন্ট। ইস্টবেঙ্গল গোল ও তাঁর মাঝে শুধু সবুজ মাঠ।
মা জাপানি, বাবা নিউজিল্যান্ডের, ভিনসেন্ট নিজে থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। বর্ণময় চরিত্র। দু’পায়ে এত ফোস্কা, বুট পরার অবস্থা ছিল না। কিন্তু প্রায় ৯০ গজের দৌড় দিলেন অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে। সঞ্জু প্রধানকে ডজ করে সোজা প্রথমে। তার পরে গতিপথ পাল্টে কোনাকুনি। গুরপ্রীত তাঁর অনেকটা পিছনে তাড়া করছেন। উপায়ান্তর না দেখে সৌমিক গোলপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে ভিনসেন্টের শটে হাত লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন। অনবদ্য দৌড়ের ফসল হাতে লেগে গোল।
এই সেই বিস্ময়কর গোল। হতভম্ব গুরপ্রীত বাঁ দিকে।
গোলদাতা ভিনসেন্ট ডান দিকে। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
গুরপ্রীতকে বিপক্ষ বক্সে উঠে যেতে নির্দেশটা দিলেন কে? তিনি কি নিজেই হঠাৎ গোল করতে গেলেন? কলকাতা ময়দানে প্রতাপ ঘোষ, হেমন্ত ডোরা, অতনু ভট্টাচার্যরা কিপার হয়েও ফরোয়ার্ড খেলেছেন। হেডে গোল করার অভিজ্ঞতা ছিল। গুরপ্রীত তো সেটাও পারেন না। দারুণ লম্বা বলে গতিও কম। উঠলে নামতে পারেন না। ম্যাচের পরে স্টেডিয়ামের বাইরে যখন সমর্থকদের বিক্ষোভ চলছে, তখন হতাশ কোচ মর্গ্যান সাংবাদিকদের বললেন, “আমিই ওকে উঠতে বলেছিলাম। কিন্তু ডিফেন্সে লোক রাখতে বলেছিলাম। সেটা ওরা শুনতে পায়নি। মোহনবাগান ম্যাচে গুরপ্রীতই খেলবে।”
বোঝা গেল না, সাহেব কোচ ‘নীলকন্ঠ’ হয়ে গুরপ্রীতের দোষ ঢাকছেন কি না। রিজার্ভ বেঞ্চে বসা অনেকেই কিন্তু মর্গ্যানের নির্দেশ শুনতে পাননি। ইস্টবেঙ্গল কোচ নিজেও ড্রেসিংরুমে ঢুকে স্বভাববিরুদ্ধ চেঁচামেচি করেছেন। “এই পাগলামির মানে হয়?”
পাগলামি, না পরিকল্পনার অভাব? খেলাটা কোনও নক আউট ফাইনাল নয়, লিগের ম্যাচ। ওই সময়ে টিনএজার গোলকিপারকে গোল করতে যেতে হবে কেন? এই পরিস্থিতিতে কর্নারে লম্বা ডিফেন্ডাররা গোল করতে গেলে মাঝমাঠে প্রতি-আক্রমণ সামলাতে থাকেন ছোটখাটো মিডফিল্ডাররা। সঞ্জু, পাইতে, হরমনজোৎরা তখন কী করছিলেন?
পুরোটাই পরিকল্পনার অভাব। ১৯৭৯ সালে কলকাতা লিগে সালকিয়া ফ্রেন্ডস-ইস্টার্ন রেল ম্যাচে পেনাল্টি কিক নিতে এসেছিলেন রেল কিপার সুজিত মুখোপাধ্যায়। সালকিয়ার কিপার অতনু ভট্টাচার্য পেনাল্টি সেভ করেই বল ছুড়ে দিয়েছিলেন। ভিনসেন্টের মতো ছুটে গোল করেছিলেন শিবব্রত নাথ। সেই অতনু এখন ইস্টবেঙ্গল কিপার কোচ। তিনিও ছাত্রকে দেখে হতভম্ব, “আমি বেঞ্চে থাকলে গুরপ্রীতকে উপরে যেতে দিতাম না।”
অতনুর ‘বস’ মর্গ্যান আর একটা বড় ভুল করলেন পেনকে তুলে নিয়ে। বিরতির পরে ইস্টবেঙ্গলই দাপিয়ে খেলছিল। মর্গ্যান সামনে লোক বাড়াতে ৪-৩-৩ ছকে গেলেন পেনকে বসিয়ে। রবীন সিংহ, এডমিলসনকে পরপর নামিয়ে। এতে মাঝমাঠ প্রয়াগের মুঠোয় চলে এল।
মর্গ্যানের প্রতিপক্ষ দলের কর্তারা আগের দিন ট্যাক্সি করে প্লেয়ারদের বাড়ি-বাড়ি ঘুরেছেন সুস্থ লোক খুঁজতে। দুই সেরা মিডফিল্ডার (লালকমল, দেবদাস), সেরা ফরোয়ার্ড (ইয়াকুবু), দু’নম্বর স্টপার (অর্ণব) নেই। তিন নম্বর মিডফিল্ডার জয়ন্ত সেনও চোট পেয়ে বসে গেলেন মাঝপথে। এই অবস্থায় ইস্টবেঙ্গল আর কোনও দিন পাবে না প্রয়াগকে। “আমি অন্য কোচদের মতো প্লেয়ার না থাকলে কান্নাকাটি করি না” বলছিলেন চেতলার সঞ্জয় সেন। তাঁর মুখে কথাটা মানায়। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল, ডেম্পো-সালগাওকর তাঁর এ বার লিগে শিকার। রঘু নন্দী, চাঁদু রায়চৌধুরী, তপনজ্যোতি মিত্রদের যোগ্য উত্তরসূরি তিনি। বড় তারকা না হয়েও সফল কোচ।
ইউনাইটেড ড্রেসিংরুমের ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা ছিল, ইস্টবেঙ্গলকে বেশি কর্নার নিতে দেওয়া যাবে না। তাঁরা দেনওনি। অনবদ্য দীপক-বেলো রজ্জাক জুটি মিলে নির্বিষ করলেন পেন-টোলগের কারসাজি। টোলগের ঘাড়ের কাছে সব সময় লোক। পেনের কাছেও। এক বারই দুর্দান্ত মুভমেন্টে দুর্দান্ত হেড করেন টোলগে, দুর্দান্ত সেভ অভিজিতের। সঞ্জয়ের পরিকল্পনা ছিল, ইস্টবেঙ্গলের উইং প্লে বন্ধ করে দেওয়া। রফিক এবং জয়ন্তকে দিয়ে মেহতাবকে অকেজো করা। হতোদ্যম মেহতাব পা চালাচ্ছিলেন। রেফারি অজিত মিতেই তাঁকে বাঁচিয়ে দিলেন দু’বার কার্ড না দেখিয়ে। নইলে মেহতাব এ বারও মোহনবাগান ম্যাচে বাইরে থাকতেন।
ম্যাচ শেষে লাঠিচার্জ চলছিল মাঠের বাইরে। অকথ্য গালাগাল। ইট-পাটকেল। যা বড় ক্লাবের সমর্থকদের একমাত্র অস্ত্র। ইউনাইটেড ড্রেসিংরুমের সামনে তখন ভিনসেন্টের অপেক্ষায় টোলগে, গুরপ্রীত, রবিন। সমর্থকদের তাড়া খেয়ে এসেও দিব্যি হাসিখুশি। দেখে মনে হল না, আকাশ ভেঙে পড়েছে মাথায়।
কর্তা ও সমর্থকদের মুখেই মেঘ, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। আই লিগটা কি তা হলে এ বারও...?




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.