প্রসূন আচার্য ও রঞ্জন সেনগুপ্ত • কলকাতা |
সোমবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ৭৯০টি ক্লাবকে আর্থিক অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ম-বিধি সব মানা হয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন উঠল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে মঙ্গলবার বলেছেন, “কিছু মানুষ এ নিয়ে মিথ্যা কুৎসা করছেন।” এ দিনও সুন্দরবন সফরে গিয়ে সেখানকার ২০০টি ক্লাবকে ২৫ হাজার টাকা করে মোট ৫০ লক্ষ টাকা মুখ্যমন্ত্রী ত্রাণ তহবিল থেকে বিলি করেছেন মমতা।
রাজ্য প্রশাসন সূত্রে বলা হচ্ছে, কোনও ক্লাবকে সরকারি অর্থ দিতে গেলে পাঁচটি ‘একান্ত জরুরি’ নথি পেশ করতে হয়।
ক) সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট অনুসারে সংশ্লিষ্ট ক্লাবের নথিভুক্তি।
খ) তিন বছরের অডিট রিপোর্ট ও সাধারণ সভার বিবরণী সরকারের কাছে যে জমা দেওয়া হয়েছে, তার প্রমাণপত্র।
গ) ক্লাবের নিজস্ব জমি ও নিজস্ব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের প্রমাণপত্র।
ঘ) নিয়মিত পুরসভা বা পঞ্চায়েতকে দেওয়া করের রশিদ।
ঙ) ক্লাব ক্রীড়া ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে কী কাজ করেছে বা করতে চায়, তার বিবরণী।
কিন্তু অভিযোগ, এ সব নথিপত্র ছাড়াই বিভিন্ন ক্লাব টাকা পাচ্ছে। এর আগে মোহনবাগান বা মহামেডান স্পোর্টিংয়ের মতো ঐতিহ্যশালী ক্লাব এক কোটি টাকা করে পেয়েছে। জঙ্গলমহলের ৭১০টি ক্লাবকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। সোমবার ২ লক্ষ টাকা করে পেয়েছে ১৯টি জেলার প্রায় আটশো ক্লাব। এর মধ্যে ৫০টি ক্লাবকে সোমবার নেতাজি ইন্ডোরে হাতে হাতে রেজিস্ট্রেশন দিয়ে ২ লক্ষ টাকার চেক ধরিয়ে দেওয়া দেওয়া হয়!
সব নিয়ম না মেনে ক্লাবগুলিকে টাকা দেওয়ার ‘ঐতিহ্য’ সেই বাম আমল থেকেই চলে আসছে বলে জানাচ্ছেন মহাকরণের প্রশাসনিক কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, এ রাজ্যে দীর্ঘদিনের ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী ক্লাবগুলিকে ‘হাতে রাখতে’ বহু সময়েই সরকারি নীতির তোয়াক্কা না করে টাকা, টিভি বা সরঞ্জাম বিলি করতেন। জ্যোতি বসুর আমলে এ নিয়ে বহু বার বিতর্কও হয়েছে। রেজিস্ট্রেশন না থাকা সত্ত্বেও মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলকে টাকা দিয়েছিলেন সুভাষবাবু। গত বছর ইস্টবেঙ্গল রেজিস্ট্রেশন করলেও অন্য দুই প্রধান আজও করেনি। তবে বাম জমানার শেষ দিকে অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত আপত্তি তোলায় এই ‘ইচ্ছামতো’ বিলি-বণ্টন বন্ধ হয়েছিল।
গত আট মাসের শাসনকালে এ রাজ্যের ক্লাবগুলিকে মোট ২১ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, রাজ্যের ক্রীড়া পরিকাঠামোর উন্নতির জন্যই তিনি এ কাজ করছেন। আর ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র বলেছেন, “টাকা যাতে নয়ছয় না হয়, সে জন্য জনপ্রতিনিধিদের (বিধায়ক, পঞ্চায়েতের প্রধান) সুপারিশ অনুযায়ী সমস্ত রকম নথিপত্র পরীক্ষা করেই ক্লাবগুলিকে টাকা দেওয়া হচ্ছে। টাকা খরচের ৬ মাসের মধ্যে অডিট রিপোর্ট জমা দিতে হবে।” পূর্ত দফতরের ইঞ্জিনিয়ারদের কাছ থেকে সমীক্ষা রিপোর্ট পাওয়ার পরেই পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য তিন প্রধানকে এক কোটি টাকা করে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মদনবাবু। তিনি বলেন, “সেনা কর্তৃপক্ষ-সহ সব পক্ষের বৈধ অনুমতি দেখেই এই টাকা দেওয়া হয়েছে। বড় ক্লাবকে টাকার হিসেব দিতে হবে।” কিন্তু মোহনবাগান ও মহামেডানের তো রেজিস্ট্রেশন নেই। সেটা ছাড়াই কী করে কোটি টাকা দেওয়া সম্ভব? মদনবাবুর বক্তব্য, “বাংলার ক্রীড়ার উন্নতির স্বার্থেই এ কাজ করা হয়েছে। অতীতেও এই ক্লাবগুলি সরকারি অর্থ পেয়েছে।” প্রসঙ্গত, মহামেডানের কর্মকর্তা তৃণমূলের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুলতান আহমেদ এবং মোহনবাগানের অন্যতম কর্তা তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সৃঞ্জয় বসু।
মহাকরণ সূত্রে বলা হচ্ছে, কোনও ক্লাব বা সংগঠন বিভিন্ন ভাবে সরকারের কাছ থেকে টাকা পেতে পারে। ক্রীড়া ও নানা সমাজসেবামূলক কাজের জন্য সাংসদ বা বিধায়ক তাঁর এলাকা উন্নয়ন তহবিল থেকে টাকা দিতে পারেন। এ ছাড়া খেলাধুলোর উন্নতির জন্য প্রতি বছর ক্রীড়া দফতরও ক্লাবগুলিকে সাহায্য দেয়। কিন্তু আইন মোতাবেক প্রতি ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট ক্লাবের রেজিস্ট্রেশন থাকতে হবে এবং টাকা নেওয়ার পরে বার্ষিক অডিট রিপোর্ট সরকারের কাছে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক।
নেতাজি ইন্ডোরের ক্ষেত্রে বিধায়ক-পিছু ৬টি ক্লাবকে টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তৃণমূল বিধায়করা এমন ১৩০টি ক্লাবকে টাকা দেওয়ার সুপারিশ করেন, যাদের রেজিস্ট্রেশন নেই! সরকারি সূত্রে খবর, এই অবস্থায় রেজিস্ট্রার অশোক ঘোষের কাছে এক সঙ্গে ১৩০টি ক্লাবের নামের তালিকা পাঠিয়ে (অন্য নথিপত্র ছাড়াই) রেজিস্ট্রি করার নির্দেশ দেয় ক্রীড়া দফতর। রেজিস্ট্রি দফতরটি শিল্প-বাণিজ্য দফতরের অধীনে। অশোকবাবু বিষয়টি শিল্প-বাণিজ্য সচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানান। বাসুদেববাবু তাঁকে বলেন, এ ভাবে রেজিস্ট্রি করা যাবে না। ইতিমধ্যেই মদনবাবু এ ব্যাপারে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সম্মতি-সহ ফাইল পাঠান বাসুদেববাবুর কাছে। শিল্প দফতরের অফিসারদের একাংশের বক্তব্য, আপত্তি থাকা সত্ত্বেও শিল্পসচিব রেজিস্ট্রারকে নির্দেশ দেন, রবিবার ছুটির দিন সত্ত্বেও ইন্ডোরে অফিসার পাঠিয়ে হাতে হাতে রেজিস্ট্রির ব্যবস্থা করা হোক। সেই মতো রবিবার ৪২টি ক্লাব এবং সোমবার আরও ৮টি ক্লাব কাগজপত্র জমা দিয়েই হাতে হাতে রেজিস্ট্রেশন নম্বর পায়। কিন্তু তাদের পক্ষে তো তিন বছরের রিটার্ন জমা দেওয়া কোনও মতেই সম্ভব নয়। তা হলে কী ভাবে সরকার তাদের টাকা দিল? জবাবে মদনবাবু বলেন, “এই ক্লাবগুলি টাকার জন্য আগেই আবেদন করেছে। বিধায়করাও ক্লাবগুলিকে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন না থাকায় তারা টাকা পাচ্ছিল না। তাই হাতে হাতে রেজিস্ট্রি করে চেক দেওয়া হল।” যদিও অর্থ দফতরে অফিসারদের মতে, এ ভাবে টাকা দেওয়া যায় না। ক্রীড়াসচিব বি পি গোপালিকা এ দিন বলেন, “পরিকল্পনা খাত থেকে ৭৯০টি ক্লাবকে ২ লক্ষ টাকা করে অর্থ সাহায্য করা হয়েছে।” বছরের মাঝখানে কী ভাবে পরিকল্পনা খাত থেকে মোট ১৫ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা খরচ করা হল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পরিকল্পনা খাতের টাকা উন্নয়নমূলক কাজের জন্য খরচ করার কথা। সরকারের নির্দেশে স্পষ্ট বলা আছে, নিজস্ব জমি ছাড়া উন্নয়নমূলক কাজের জন্য টাকা দেওয়া যাবে না। অথচ নেতাজি ইন্ডোরের অনুষ্ঠানে নিজস্ব জমির দলিল ছাড়াই বহু ক্লাব টাকা পেয়েছে। যার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “ছোটখাট ক্লাব নিজস্ব জমি পাবে কোথায়?” সরকারি অফিসারদের প্রশ্ন, বেআইনি ভাবে বা দখল জমির উপরে গড়ে ওঠা কোনও ক্লাব সরকারি টাকা পাওয়ার পরে জমির বৈধতা চেয়ে আদালতে গেলে সরকার কী করবে? তা ছাড়া, বহু ক্লাবই কাজের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা জমা দেয়নি বলে অভিযোগ। অর্থ দফতরের এক অফিসারের কথায়, “বিনা পরিকল্পনায় ‘প্ল্যান-বাজেটে’র অর্থ খরচ সম্পূর্ণ বেআইনি।” আবার সুন্দরবনে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ক্লাবগুলিকে টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন মমতা। সরকারি সূত্রের বক্তব্য, সাধারণ ভাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং দুঃস্থদের চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্য এই তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্দ করা হয়। ফলে প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। |