বইমেলা কেবল শীতঋতুর কেন্দ্রীভূত পার্বণ হয়ে থাকবে কেন?
নানা অঞ্চলে কেন নিয়মিত ছোট ছোট ‘বইমেলা’হবে না?
এক অন্য বিকেন্দ্রীকরণের স্বপ্ন দেখেছেন
অশোক মিত্র |
বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘ ঋতুর প্রথম অধ্যায়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে মস্ত আলোড়ন তোলা হয়েছিল। কেন্দ্র থেকে রাজ্যে, রাজ্য থেকে জেলায় জেলায়, জেলা থেকে নগণ্যতম জনপদে প্রশাসন ও সেই সঙ্গে প্রশাসন পরিচালনায় প্রয়োজনীয় পয়সাকড়ি ছড়িয়ে দিতে হবে, এই দাবিতে রাজ্যের আকাশ-বাতাস মুখরিত, ফাঁকা দেওয়াল পেলেই বড় বড় অক্ষরে দাবি ঘোষণা: বিকেন্দ্রীকরণ চাই, রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা চাই। রাজনৈতিক চাপান-উতোরের ভাষা তখনও শালীনতার সীমা অতিক্রম করে যায়নি। তখন মস্ত বিদ্যুৎ সংকট চলছে গোটা রাজ্য জুড়ে, স্বভাবতই সরকারে আসীন দলের প্রতিপক্ষ প্রতিবাদে মুখর। প্রতিবাদকে যে কৌতুকে খানিকটা স্নিগ্ধ করা যায়, হঠাৎ তার সাক্ষ্য: রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা দিতে হবে, এই বিঘোষণার পাশাপাশি একই দেওয়ালে সমান সোচ্চার দাবি: রাজ্যের হাতে অধিক মোমবাতি দিতে হবে।
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে সেই আলোড়ন হঠাৎ অবশ্য ঝিমিয়ে পড়েছিল। অন্য এক ধরনের বিকেন্দ্রীকরণ কিন্তু আমাদের পরিপার্শ্বে গত কয়েক দশকে সংঘটিত হয়ে গেছে বইমেলার বিকেন্দ্রীকরণ! গত শতকের সত্তরের দশকে কিছুটা ঝোঁকের মাথায়, কিছুটা ঝাপসা ঝাপসা আবেগের তাড়নায় কলকাতার ময়দান অঞ্চলে ভীরু মাধবীর মতো যে একক বইমেলার জেগে ওঠা, তা এখন এই শহরের শুধু পাড়ায় পাড়ায় নয়, অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। রাজশেখর বসু বেঁচে থাকলে দেখে পুলকিত হতেন, তাঁর বর্ণনায় দীপক সংঘ-কোরক সংঘ-রা আর নিছক ফুটবল খেলা বা সরস্বতী পুজো নিয়ে প্রতিযোগিতার আড়াআড়ি হয় না, কাদের বইমেলায় তেইশটা স্টল পড়েছে আর অন্য কাদের মেলায় সাড়ে ছাব্বিশটা, তা নিয়ে এখন ঘোর তর্ক-বিসংবাদ। বইয়ের প্রদর্শনের এই ঘোর বিকেন্দ্রীকরণের অনুষঙ্গে ধূলি বিচ্ছুরণেরও বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেছে। মেলায় ভিড় করা মানুষজনের ঘুরে বেড়ানো থেকে ময়দানে যে ধুলো উড়ত, তা-ও এখন জনপদভারে বিকেন্দ্রীভূত। |
পাঠ। পুরুলিয়ায় বইমেলা। জানুয়ারি ২০১২। ছবি: প্রদীপ মাহাত |
কিন্তু এখানেই তো থেমে থাকেনি, ক্রমে ক্রমে বইমেলা ছোট-বড় প্রতিটি জেলা, মহকুমা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। শীত ঋতুতে সাহিত্যিককুল তথা বড়-মাঝারি-ছোট রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মেলার পর মেলা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার তাগিদে উদ্ভ্রান্ত। প্রকাশককুলের উপর সমান চাপ, তাঁরাও যেন দয়া করে একটু গা-ঝাড়া দিয়ে তাঁদের বইয়ের বান্ডিল এ শহরে-ও শহরে চংক্রমণে ব্যতিব্যস্ত, এটা নাকি তাঁদের সামাজিক দায়িত্বও। বর্ধিষ্ণু গ্রামাঞ্চলও বইমেলার প্রসাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না, বইমেলার বিকেন্দ্রীকরণ গোটা রাজ্য জুড়ে বাস্তবায়িত।
কান টানলে মাথা আসে। বইমেলা যত ছড়িয়ে যাচ্ছে, রাজ্যের প্রত্যন্ত জুড়ে সেই সঙ্গে অণু-পত্রিকাগুলিরও সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটছে, তাদেরও দ্রুত বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া চলছে। ভারিক্কি প্রবীণ কবি হয়তো পূর্ব মেদিনীপুরে বা কোচবিহারের গহন অভ্যন্তরে বইমেলা উদ্বোধন করতে গেছেন, একসঙ্গে প্রায় এক ডজন অণু-পত্রিকার সম্পাদক তাঁদের সদ্য-প্রসূত পত্রিকা কে তাঁর হাতে সর্বপ্রথম গুঁজে দেবেন সেই বিতণ্ডার আবর্তে বিধ্বস্ত হচ্ছেন। তবে শুধু অণু-পত্রিকাই তো নয়, বইমেলা উপলক্ষে এত ভঙ্গ বঙ্গদেশের কয়েক লক্ষ কবিযশঃপ্রার্থীদের সমান ডানা ঝাপটানো। কম্পিউটারের ব্যবসাও তো আস্তে ধীরে গ্রামে-গঞ্জে ব্যাপ্ততর হচ্ছে। দেড় ঘণ্টার মধ্যে চার ফর্মার একটি কাব্যপুস্তক প্রস্তুত করা তাই আর শিবের বাপের অসাধ্য নয়। আর বইমেলার উষা-মুহূর্তেই অশান্তি কী দহন জ্বালায় কে জানে, ভাবুক বিপ্লবীরা তাদের দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে উপস্থিত! সন্ধ্যা একটু ঘন হয়ে এলে স্লোগানের মুখরিত মূর্ছনায় প্রাঙ্গণের প্রান্ত কাঁপিয়ে তাদের বিতর্কসভা। হয়তো সেই জমায়েতের কলরোল সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মাটিতে উবু হয়ে বসে এক উঠতি চিত্রশিল্পীর ক্যানভাসে নিমগ্ন সাধনা, তাতে কিছু যায় আসে না। দু’কদম এগিয়ে একটি তেরছা কোণে এক দঙ্গল নবীন বাদকবৃন্দ তাঁদের কাড়ানাকাড়া নিয়ে জগঝম্পরত। বইমেলাকে যার যতটুকু দেয় আছে, উজাড় করে দিচ্ছেন। অগ্রহায়ণ মাস পৌষের গা স্পর্শ করতে না করতেই সারা বাংলা জুড়ে এক আশ্চর্য আকুলতা। শুনতে পাই ও পার বাংলাও এই একই কাঁপুনিতে সমপরিমাণ আক্রান্ত।
অর্থাৎ, আমরা একটি আস্ত নতুন সংস্কৃতিতে প্রবেশ করেছি। ঋতুর অবসান ঘটলে পুস্তক-ব্যবসায়ীরা হিসেব করতে পারেন গোটা রাজ্যে সমস্ত বইমেলা জুড়ে কত মানুষ সমবেত হয়েছিলেন, কত কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে, সেই সঙ্গে চা-কফি গোছের স্টল খুলেছিলেন যে ব্যাপারিরা, তাঁরাও তাঁদের আয়-ব্যয়ের খবর দাখিল করবেন। রেস্তোরাঁ, মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীরাও করবেন। বাঙালি সত্তার তো শত রূপ! বই ঘাঁটছি, বাদাম খাচ্ছি, বই কিনছি, ফাঁকে ফাঁকে কফিখানায় সেঁধিয়ে যাচ্ছি, বইয়ের প্যাকেট নিয়ে বেরোবার উদ্যোগ করছি, একটু গরম-গরম ভাজা মুরগির ঠ্যাং লেহন করব না কেন? তা ছাড়া, সার্ধশতবর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষ হোক না-হোক, রবীন্দ্রনাথের গান বাদ দিয়ে তো আমরা অস্তিত্ববিহীন। অতএব ছ’বছরের যে শিশুকন্যা হারিয়ে গেছে, তাকে কোন দফতরে বাবা-মা’র হাতে প্রত্যর্পণ করা হবে, অথবা জনৈকা প্রেমিকা তার প্রেমিককে কোন পুস্তক বিপণীতে হাজির হতে আদেশ করছেন, সে সব সবিস্তার ঘোষণার সুড়ঙ্গ পথে হয় তুমি রবে নীরবে পূর্ণিমা নিশিথিনীসম নয়তো হা-রে-রে-রে-রে-রে আমায় ছেড়ে দে রে দে রে নিজেদের রচিত সংস্কৃতি বাঙালি সমাজকে আগাপাশতলা মুড়ে রাখবে প্রতিটি বইমেলায়। এবং অবশ্য ক’দিন বাদে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে পরিবেশবিদরা নিকষ নিখুঁত পাটিগণিত পরিবেশন করবেন, বইমেলা হেতু কত বাড়তি বিষ বাংলার আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে। সামগ্রিক সংস্কৃতি।
অথচ একটি অভাব-বোধের অনুভূতি যেন কুরে কুরে খায়। ম্লান-স্তিমিত মফস্সল শহরে বাল্যকাল কেটেছে। একটি বিশেষ স্মৃতি থেকে থেকে মনের পর্দায় ছায়া ফেলে। সন্ধ্যা সমাগত, কনে-দেখা আলোও অবসিত, অপরিসর রাস্তা দিয়ে এক ফেরিওয়ালা ক্লান্ত গলায় আর্তস্বর তুলে নিবেদন জানাচ্ছেন: ‘ভাল ক খ বই চাই, ক খ বই’ একটু থেমে পরমুহূর্তে তাঁর উচ্চারণ: ‘খোকা লো, খুকি লো, মা-র কাছে কেঁদে কেঁদে গিয়ে বল, মা আমাকে একটা পয়সা দাও, আমি ক খ বই কিনব।’ হয়তো সারা বিকেল সন্ধ্যায় সেই ফেরিওয়ালা দশটি কি পনেরোটি বর্ণপরিচয় বিক্রি করতে সফল হতেন, বড় জোর তার অর্ধেক তাঁর নিট উপার্জন, কিন্তু সেই সঙ্গে এক গভীর সামাজিক কর্তব্যও তো তাঁর দীর্ণবৃত্তির মধ্যবর্তিতায় সংসাধিত হত। পরাধীন দেশ, বিদেশি প্রভুরা গোলামদের গোয়ালঘরে সামান্যতম শিক্ষাদানের ঝক্কি নিতে আগ্রহ দেখাননি। যারা অন্ধকারে আছে, তাদের অন্ধকারে রাখাই শাসককুলদর্শন। তা হলেও এখানে-ওখানে বিদ্যানুশীলনের পালা শুরু। বিদ্যাসাগর-তর্কালঙ্কার মশাইরা বুকঢালা মমতা নিয়ে বর্ণপরিচয় রচনা করেছেন। মফস্সল শহরে গোধূলি লগ্নে মলিনবেশ ফেরিওয়ালার ক্লান্ত আকুতি সেই খুদে পুস্তকটির বন্দনা ঘোষণা করছে। দেশের অসহায় অভুক্ত-অর্ধভুক্ত মানুষগুলির মধ্যে অন্তত গুটিকয় আলোর অভিযাত্রী হওয়ার প্রথম সুযোগ পাচ্ছেন।
তাই দ্বিধাবিজড়িত নিবেদন, খুব কি বেমানান হত আমার শৈশবে দেখা সেই জরাজীর্ণ পরিধেয়, ক্লান্ত-অবসন্ন কণ্ঠস্বর সংবলিত ফেরিওয়ালাকে যদি আমাদের এই সময়ের কোনও বইমেলায়, যে-কোনও বইমেলায়, বর্ণপরিচয় ফেরি করবার কথা বলা হত! ‘খোকা-খুকি’র মায়েরা তো আর দূরবর্তিনী নন, তাঁরা তো নিজেরাই মেলায় সঞ্চারবতী, ফেরিওয়ালার আকূতি সরাসরি তো তাঁদের কাছেই পৌঁছে যেতে পারবে। এমনটাও বলা চলবে না যে আমার কল্পনায় যৌক্তিকতা নেই, যেহেতু মেলায় ঘুরে যাওয়া গিন্নিবান্নিরা প্রধানত সচ্ছল পরিবার থেকেই আসেন। তাঁদের ছেলেমেয়েরা খাসা-খাসা বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছে, তাদের আর বর্ণপরিচয়ের প্রয়োজন নেই। বিশেষ করে তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাতৃভাষাকে অনাসৃষ্টি বলে বিবেচনা করেন। কেজো পৃথিবীতে ওই ভাষার নাকি কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই, বর্ণপরিচয় মলিন বস্ত্রের মতো পরিত্যাজ্য পদার্থ। তা ছাড়া, সেই সঙ্গে আমার শৈশবে দেখা সেই ফেরিওয়ালা সম্প্রদায় তাঁদের অবসাদ-আর্তি নিয়ে কবে মিলিয়ে গেছেন, তাঁদের নিয়ে স্বপ্ন-বিলাসিতা অর্থহীন।
একটু অন্য রকম ভাবা কি সম্ভব নয়, উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তদের একটি বড় অংশ আপাতত বিশ্বায়নের গোচারণভূমিতে ব্যাপৃত, তাঁদের উত্ত্যক্ত করার ধার-কাছ দিয়ে যেতে নেই, কিন্তু রাজ্যের জনসংখ্যার প্রধান অংশেরই কাছেই তো তাঁদের বর্তমান সামাজিক-আর্থিক বাধ্যবাধকতা হেতু সুদূরের পিয়াসী হওয়ার বাসনা থেকে নিবৃত্ত থাকতে হবে। মাতৃভাষাই তাঁদের নির্ভর হতে বাধ্য, সেই ভাষায় কেন তাঁরা নিরক্ষর থাকবেন? ভাবতে ভাল লাগে, প্রতিটি বইমেলা যে অবয়ব এখন পেয়েছে, তা অক্ষত-অক্ষুণ্ণ রেখেও কর্তৃপক্ষ উৎসাহভরে একটি নতুন ব্যবস্থা প্রণয়ন করবেন: মেলা যে ক’দিন করবেন নিজ নিজ সাধ্য অনুযায়ী, তাঁরা বড় হোক ছোট হোক, একটি প্রাথমিক শিক্ষা-শিবিরের আয়োজন করবেন। প্রতিদিন একশো হোক, দু’শো হোক, আরও কিছু বেশি হোক, এখনও পর্যন্ত অক্ষরপরিচয়হীন দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জড়ো করে ক খ শেখার বই তা বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় হতে পারে, রবীন্দ্রনাথের সহজপাঠও, ধৈর্য ধরে বিদ্যার্থীদের প্রথম পাঠে দীক্ষিত করবেন, মেলার সমাপ্তি দিবসে তারা যেন সম্পূর্ণ সাক্ষর হয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। যে যে মেলা অপেক্ষাকৃত সঙ্গতিসম্পন্ন, তাদের কর্তাব্যক্তিরা আরও এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারেন। প্রতি মাসে প্রতি রবিবার অঞ্চল ধরে ধরে তাঁরা শিক্ষা-শিবিরের ব্যবস্থা করতে পারেন। বইমেলার পরিচয় তা হলে শীতঋতুর পার্বণ হয়ে থাকবে না, তা বছর জুড়ে বইয়ের উপযোগিতার কথা সমাজকে শোনাবার সুযোগ পাবে।
বইপত্তর নিয়ে ব্যবসাদি করেন যাঁরা, তাঁরা একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবেন, এই নতুন উদ্যম শুধু সামাজিক সার্থকতা জড়িতই নয়, তাঁদের বাণিজ্যবৃদ্ধির একটি মূল্যবান প্রকরণ হতে পারে। তাঁরা নিরক্ষরতা দূর করার সঙ্গে সঙ্গে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ পাঠকদের সংখ্যাও উত্তরোত্তর বাড়িয়ে তুলছেন। ‘চাই ভাল ক খ বই’ সম্ভাষণে মানহানির আশঙ্কা নেই, বিনামূল্যে বর্ণপরিচয় বা সহজপাঠ বিতরণের মধ্যেও, বরঞ্চ সামাজিক দায়বদ্ধতা পরিপূরণের পাশাপাশি তা অতীব ফলপ্রসূ, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও। |