|
|
|
|
পুরসভার ময়লা ফেলার গাড়িই তেল চুরির উৎস, অভিযোগ |
আর্যভট্ট খান ও জয়তী রাহা |
সকাল ১০টা। স্থান ধাপা ডাম্পিং গ্রাউন্ড।
পুরসভার ময়লা ফেলার কিছু নিজস্ব খালি গাড়ি সেখানে পৌঁছনোর আগে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে। সাফাই অভিযানের ব্যস্ত সময়ে কেন এ ভাবে দাঁড়িয়ে গাড়িগুলি?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাসিন্দার অভিযোগ, “ওরা ‘ট্রিপ চুরি’ করছে। তেল পাচার করার জন্য। দীর্ঘ দিন ধরেই চলছে কারচুপি।”
সকাল সাড়ে ১০টা। ধাপার আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ওই গাড়িগুলিই স্থানীয় এলাকার ময়লা তুলে ফের ডাম্পিং গ্রাউন্ডে ঢোকার জন্য ওজনের লাইনে দাঁড়াচ্ছে। পারমিট নিয়ে ঘুরপথে যাচ্ছে একটু আড়ালে। দূর থেকে অচেনা গাড়ি চোখে পড়তেই সতর্ক গাড়িগুলি। দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলির কাছাকাছি পৌঁছতেই নজরে পড়ল ঝোপের আড়ালে লুকনো অর্ধেক তেলভর্তি ৩৫ লিটারের জেরিক্যান, তেল চোয়ানো আরও দু’তিনটি জেরিক্যান এবং রবারের পাইপ।
পুরসভা ও স্থানীয় সূত্রে খবর, ধাপায় আবর্জনা ফেলার কাজে দু’ধরনের গাড়ি ব্যবহার করে কলকাতা পুরসভা। কিছু ভাড়ার গাড়ি আর বাকি নিজস্ব গাড়ি। প্রতি দিন গড়ে তিনটি করে ট্রিপ খাটে পুরসভার এক-একটি গাড়ি। অভিযোগ, সব ট্রিপ না খেটে ধাপার আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকে কিছু গাড়ি। সেই ট্রিপের জন্য বরাদ্দ তেলই বার করে নেওয়া হয়। এই অভিযোগ উঠছে মূলত পুরসভার নিজস্ব গাড়ির বিরুদ্ধেই। |
|
এ ভাবেই চলছে তেল চুরি। ধাপা ডাম্পিং গ্রাউন্ডে। —নিজস্ব চিত্র |
এলাকার বাসিন্দা সামসের আহমেদ বলেন, “রোজই রবারের পাইপ দিয়ে তেল টেনে জেরিক্যানে ভরে ওরা। ভ্যান আর সাইকেলে বোঝাই হয়ে তা পৌঁছয় দক্ষিণ ২৪ পরগনার সন্দেশখালি, ধামাখালি, বানতলা, বাসন্তী হাইওয়ে, মালঞ্চ, ঘটকপুকুর, লেদার কমপ্লেক্স, বামনঘাটার মতো বহু অঞ্চলে।
বাসিন্দারা বলছেন, সে সব এলাকার আনাচকানাচে, এমনকী মুদির দোকানেও মেলে এই কাটা ডিজেল। বাজার চলতি দর থেকে যার দাম লিটারপিছু ২০-২৫ টাকা কম। চাষের জমিতে পাম্প চালানোর কাজে, জলে ভটভটি কিংবা ট্রলার চালাতেই মূলত ব্যবহার হচ্ছে এই তেল।
নিয়মানুযায়ী, ডাম্পিং গ্রাউন্ডে ঢুকতে সব গাড়িরই ট্রিপ কার্ড লাগে। ভাড়ার লরিগুলিকে তা দেয় ওয়ার্ডের ব্লক সরকার। আর পুরসভার নিজস্ব গাড়ির প্রতি ট্রিপের জন্য কার্ড দেওয়া হয় আটটি পুর-গ্যারাজ থেকে। কার্ডে লেখা থাকে কোথা থেকে, কী ধরনের ময়লা তোলা হচ্ছে। ডাম্পিং গ্রাউন্ডে ঢোকার সময়েই আধুনিক পদ্ধতিতে ওজন করে নেওয়া হয়। পুরসভার কঠিন বর্জ্য বিভাগের দাবি, তার ভিত্তিতে হিসেব রাখা হয় ট্রিপ সংখ্যা এবং ময়লার পরিমাণের।
তবুও কারচুপি হচ্ছে কী ভাবে? পুরসভা বলছে, এতে জড়িত পুর-কর্মীদেরই একাংশ। ব্যবসার স্বার্থে স্থানীয় দরিদ্র বাসিন্দাদেরও জড়িয়ে ফেলা হয়েছে এই কাজে। এলাকাটি জনমানব শূন্য হওয়ায় বাড়তি সুবিধে মিলছে। ফলে অবৈধ উপায়ে তেল টানার কালো ব্যবসা গত দু’দশকে ফুলে উঠেছে।
পুরসভার তথ্য বলছে, শহরের ১৪১টি ওয়ার্ডের দৈনিক প্রায় ৪,৫০০ মেট্রিক টন ময়লা তুলে ধাপা ডাম্পিং গ্রাউন্ডে ফেলা হয়। কাজে নিযুক্ত পুরসভার ১২০টি নিজস্ব গাড়ি প্রতি দিন ৪০০টি ট্রিপ এবং ৩০০টি ভাড়ার লরি দৈনিক ৮০০-৮৫০ ট্রিপ খাটে। পুরসভার কঠিন বর্জ্য বিভাগের হিসেব অনুযায়ী, নিজস্ব গাড়িগুলির প্রতি ট্রিপের জন্য ১১ লিটার ডিজেল পায়। অর্থাৎ, দৈনিক ৪,৪০০ লিটার তেলের খাতে প্রায় ১,৮০,০০০ টাকা দেয়। ভাড়ার গাড়িগুলিকে প্রতি মেট্রিক টন ময়লা সাফাইয়ের জন্য ২২০-২৪০ টাকা দিয়ে থাকে পুরসভা। এর জন্য দৈনিক খরচ পড়ে ১,৭৬,০০০ টাকা।
তেলের কারচুপির কথা স্বীকার করছেন পুরসভার ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল পুর-প্রতিনিধি শম্ভুনাথ কাও। তিনি বলেন, “এলাকাটি ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডে। পুরসভার বর্জ্য বিভাগের কিছু কর্মীর যোগসাজশে ওই কাজ চলছে।” তাঁর দাবি, “স্থানীয় থানায় অভিযোগ জানিয়েও সাহায্য পাইনি। থানার পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট গাড়ির নম্বর-সহ অভিযোগ করতে বলা হচ্ছে। ওটা তো পুলিশের কাজ।”
পুরসভার কঠিন বর্জ্য বিভাগের বর্তমান মেয়র পারিষদ দেবব্রত মজুমদার বলেন, “অভিযোগের কথা শুনেছি। লিখিত কিছু পাইনি। এখনই এই বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।”
তেল কারচুপির কথা মানছেন বর্তমান মেয়র পারিষদ (উদ্যান) দেবাশিস কুমারও। তাঁর কথায়, “প্রায় দশ বছর আগে সাত নম্বর বরোর চেয়ারম্যান থাকাকালীন এই অভিযোগে হাতেনাতে ধরেছিলাম পুরসভার কিছু কর্মীকে। লিখিত ভাবে ক্ষমা চাওয়ায় তখন ছাড়া পান তাঁরা।” তিনি জানান, পুরসভাকে এর জন্য বড় ধরনের মাশুল গুণতে হচ্ছে। আইনগত কঠোর পরিবর্তন না আনলে এ কাজ আটকানো কার্যত অসম্ভব। চুরি চক্রের বিষয়ে ওয়াকিবহাল স্থানীয় প্রগতি থানাও। এক অফিসারের কথায়, “অভিযোগ পেয়ে দু’বার অভিযানে গিয়েছি। কিন্তু ফাঁকা জেরিক্যান ও তেলের পাইপ ছাড়া কিছুই পাইনি।” কলকাতা পুলিশের দক্ষিণ-পূর্ব ডিভিশনের ডিসি বাসব দাশগুপ্ত বলেন, “বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। ঘটনাটি যেহেতু ধাপার মাঠে হচ্ছে বলে অভিযোগ, তাই পুরসভাকে বেশি সচেতন থাকতে হবে। পুরসভা আমাদের বিষয়টি জানালে যৌথ ভাবে অভিযান চালানো যাবে। স্থানীয় প্রগতি থানাকে আরও সচেতন করে দিচ্ছি।” |
|
|
|
|
|