রোগ পুরনো। কিন্তু চিকিৎসা না-হওয়ায় রোগ এখন হাতের বাইরে চলে গিয়েছে।
শিশুমৃত্যু নিয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের কাছে জমা দেওয়া রিপোর্টে ওই রোগের দাওয়াই খুঁজতে স্বাস্থ্যকর্তাদের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন বিধানচন্দ্র রায় শিশু হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ। তাঁরা জানান, চিকিৎসক বা নার্সদের গাফিলতি নয়, জেলা হাসপাতাল থেকে মাত্রাছাড়া হারে রোগী ‘রেফার’ করায় প্রতিটি অসুস্থ শিশুকে সমান পরিষেবা দেওয়া অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন চাই।
এর মধ্যেই তৃণমূল নেতা তথা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় সোমবার দিল্লিতে দাবি করেছেন, অন্যান্য রাজ্যের থেকে পশ্চিমবঙ্গে শিশুমৃত্যুর হার অনেক কম। তিনি জানান, গোটা দেশে প্রতি হাজার জনে শিশুমৃত্যুর হার ৪৭। পশ্চিমবঙ্গে সেটা ৩১। সুদীপবাবুর দাবি, “নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ওই গড় আরও তিন সূচক কমেছে। আগামী বছরের পরিসংখ্যানে সেটা বোঝা যাবে।” তিনি জানান, পশ্চিমবঙ্গে এক মাস বয়সের শিশুর মৃত্যুর হার জাতীয় গড়ের থেকে অনেক কম। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন মহল শিশুমৃত্যুর খবর যে-ভাবে প্রচার করছে, তার পিছনে চক্রান্ত আছে বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।
নেতাদের পরিসংখ্যান যা-ই বলুক, তা কোনও মতেই মৃত শিশুদের পরিজনদের ক্ষোভ সামাল দিতে পারছে না। শনি থেকে রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিসি রায় হাসপাতালে পাঁচটি শিশুর মৃত্যুর হয়। ক্ষুব্ধ আত্মীয়স্বজন হাসপাতালের সামনের রাস্তা অবরোধ করেন। সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত হাসপাতালে আরও তিনটি শিশু মারা গিয়েছে। এ দিনও বিক্ষোভ হয় হাসপাতাল-চত্বরে। হাসপাতালের রেকর্ড অবশ্য বলছে, সেখানে দৈনিক ৫-৬টি শিশুর মৃত্যু স্বাভাবিক ঘটনা। হাসপাতালের কার্যনির্বাহী অধ্যক্ষ মালা ভট্টাচার্যের কথায়, “দিনরাত হাসপাতালে পড়ে থেকেও আমাদের চিকিৎসকেরা সব শিশুকে বাঁচাতে পারছেন না। কারণ এত রোগী রেফার হয়ে এলে একটা হাসপাতালের পক্ষে সব সময় ‘কোয়ালিটি সার্ভিস’ (উঁচু মানের পরিষেবা) দেওয়া সম্ভব হয় না। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে পরিষেবা পেতে পেতে সেই শিশুদের মধ্যে অনেকে মারা যায়।”
ওই হাসপাতালে নথিভুক্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী শুধু জানুয়ারিতেই প্রায় ৪৫০টি শিশু রেফার হয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে কলকাতার অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে রেফার হওয়া শিশুও রয়েছে। এ দিন হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি শয্যায় দু’তিন জন মা শিশুদের নিয়ে বসে রয়েছেন। চিকিৎসক ও নার্সেরা বলছেন, এই অবস্থায় সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা বেশি। বাড়ে মৃত্যুর হার। সেই সঙ্গে রয়েছে বহির্বিভাগের চাপ। নার্সিং সুপার পুষ্পা ঘোষ জানান, এ দিন শুধু বহির্বিভাগেই সাড়ে চারশোর বেশি শিশুকে নেবুলাইজার দিতে হয়েছে।
বিসি রায়ের মেডিসিনের ৩৬১টি শয্যায় এ দিন ৩৪১টি শিশু এবং তাদের মায়েরা ছিলেন। অ্যানেক্স ভবনে মেডিসিনের ১৫০টি শয্যায় গুরুতর অসুস্থদের রাখা হয়। তাই সেখানে এক জন করে রোগী থাকে। ফলে পুরনো ভবনের মেডিসিনের শয্যায় আরও চাপ বাড়ে। সেখানে কখনও কখনও এক শয্যায় তিন-চারটি শিশুকেও রাখা হয়। বিসি রায়ের সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট বা এসএনসিইউ-এ খাতায়-কলমে ৪০টি শয্যা থাকলেও চালু আছে ২৪টি। চিকিৎসক না-বাড়ালে এসএনসিইউ-এ সব শয্যা চালু করা যাবে না বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।
জেলা থেকে রেফার-স্রোত ঠেকানো যাচ্ছে না কেন? স্বাস্থ্যকর্তারা বলছেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেলা হাসপাতালে পরিকাঠামো বাড়ানোর কথা বললেও সেখানে পেডিয়াট্রিক ভেন্টিলেটর নেই। নেই অন্যান্য সরঞ্জামও। ফলে শিশুদের অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি নেওয়া যায় না। বিশেষজ্ঞের অভাবে বহু মহকুমা ও স্টেট জেনারেল হাসপাতালে স্ত্রীরোগ ও শিশুরোগ বিভাগ বন্ধ। তাই বিসি রায়ে রেফার করা ছাড়া গতি নেই। ফলে বিসি রায়ের রোগও সারছে না।
বিধানসভার বিরোধী দলনেতা, সিপিএমের সূর্যকান্ত মিশ্র নতুন সরকারকে কটাক্ষ করে এ দিন পশ্চিম মেদিনীপুরে বলেন, “বাম আমলেও শিশুমৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু এ তো মাসের পর মাস শিশু মৃত্যুর মিছিল চলছে! যেটুকু পরিকাঠামো আছে, সে তো আমাদের আমলেই হয়েছে।”
আর সুদীপবাবু দিল্লিতে বলেন, “বাম আমলে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছিল। নতুন সরকারকে জেলা হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসার উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। বিশেষ করে শিশুদের জন্য।” দ্বাদশ যোজনায় স্বাস্থ্য খাতে রাজ্যের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান সুদীপবাবু। শিশুমৃত্যু নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন সুদীপবাবু। পরে তিনি বলেন, “শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে ১৬টি রাজ্যের পরিসংখ্যান পশ্চিমবঙ্গের থেকে খারাপ। তা সত্ত্বেও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে শুধু পশ্চিমবঙ্গের ঘটনা নিয়ে হইচই করা হচ্ছে।” তবে মন্ত্রকের একটি সূত্র জানাচ্ছে, অল্প সময়ের ব্যবধানে জেলায় একাধিক শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটায় সমালোচনা শুরু হয়েছে। এই চক্রান্তের পিছনে সরকারি কর্মীদের একাংশের জড়িত থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেননি সুদীপবাবু। |