|
|
|
|
কৃষক-আত্মহত্যা বিতর্কে ইন্ধন খাদ্যমন্ত্রীর |
সরকার যথাসাধ্য করছে, সুর বদলালেন নারায়ণন |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
রাজ্যে কৃষকদের অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে আগের বক্তব্য থেকে অনেকটাই সরে এলেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন। দাঁড়ালেন রাজ্য সরকারের পাশেই।
২৩ জানুয়ারি নেতাজি ভবনে এক অনুষ্ঠানের পরে রাজ্যে কৃষক মৃত্যুর ঘটনাকে দুর্ভাগ্যজনক বলেছিলেন রাজ্যপাল। সেখানেই থেমে না থেকে ওই কৃষকদের অনেকেই ঋণভারে জর্জরিত ছিলেন, বলেও মন্তব্যও করেছিলেন তিনি। যদিও খোদ মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, মাত্র এক জন কৃষকই আত্মঘাতী হয়েছেন।
এর ঠিক সাত দিন পরে সোমবার রাজ্যপালের গলায় শোনা গেল অন্য সুর। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর মৃত্যুদিন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ব্যারাকপুর গাঁধীঘাটে গিয়েছিলেন নারায়ণন। অনুষ্ঠানের পরে কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা রাজ্যপাল বলেন, “রাজ্য সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।” কলেজে কলেজে অধ্যক্ষ নিগ্রহ, ছাত্র সংঘর্ষ এবং তার পরে কৃষকদের অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে রাজ্যপালের মন্তব্যে রাজভবনের সঙ্গে মহাকরণের সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এ দিন রাজ্যপালের মন্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়।
তবে কৃষক মৃত্যু নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতোর কিন্তু থেমে নেই। এ দিন তাতে ইন্ধন দিয়েছেন রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। মহাকরণে তিনি বলেন, কোনও কৃষক ঋণ নিয়ে ব্যক্তিগত কাজে (বাড়ি বানানো বা সন্তানদের শিক্ষা) লাগালে তার দায়িত্ব সরকার নিতে পারবে না। একই সঙ্গে তাঁর দাবি, এ পর্যন্ত এক জন কৃষকের মৃত্যু প্রমাণিত। বাকিরা কৃষক বলে প্রমাণিত হয়নি।
রবিবার মালদহের গাজলের বাবুপুরে আত্মঘাতী দয়াল বর্মনও চাষি নন বলে দাবি করেছেন মালদহের জেলাশাসক শ্রীমতী অর্চনা। সোমবার তিনি বলেন, “বিডিও-র রিপোর্টে বলা হয়েছে নিজস্ব দেড় বিঘা জমি থাকলেও তিনি পেশায় কাঠমিস্ত্রি। চাষের জন্য নয়, মেয়ের বিয়ে ও কাঠের কাজের জন্য তিনি ঋণ নিয়েছিলেন। তা শোধ করতে না পেরেই আত্মঘাতী হন দয়ালবাবু।” |
|
পোড়ানো হচ্ছে ধান। রায়গঞ্জের কর্ণজোড়ায়। ছবি: তরুণ দেবনাথ। |
যদিও কংগ্রেস এবং সিপিএমের দাবি, দয়ালবাবু কৃষক। বাবুপুরের সিপিএম পঞ্চায়েত প্রধান সিরাজুল ইসলাম বলেন, “চাষবাসই দয়ালবাবুর পেশা। মাঝেমধ্যে কাঠের কাজ করতেন। চাষের জন্যই ঋণ নেন। পরে মেয়ের বিয়ের জন্য আরও কিছু ঋণ নিয়েছিলেন।” পশ্চিম মেদিনীপুরে সিপিএমের জেলা সম্মেলনের ফাঁকে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “কে কৃষক সেটা সরকারকে বোঝাতে হচ্ছে, এটা দুর্ভাগ্যের।
কত ধানে কত চাল, সরকার বুঝল না!” ধান কেনার বিষয়টি নিয়ে ৬ ফেব্রুয়ারি বামফ্রন্টের প্রতিনিধি দল খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন বলে জানান সূর্যবাবু।
জেলার কংগ্রেস সাংসদ মৌসম বেনজির নুর বলেন, “সরকার ধানের দাম বেঁধে দিলেও চাষিরা ধান বিক্রি করতে পারছেন না। চাল মিলের মালিকরা ওই দামে ধান কিনছেন না।” তাঁর অভিযোগ, ধান বিক্রি করতে না পেরে চাষিরা আত্মহত্যা করলেও সরকারের নির্দেশে প্রশাসন তা ধামাচাপা দিতে তৎপর।
ধান কেনা নিয়ে জেলায় জেলায় বিক্ষোভও অব্যাহত। এ দিন সরকারি উদ্যোগে চাষিদের থেকে সরাসরি ধান কেনার দাবিতে ও রেশন সরবরাহে অনিয়মের অভিযোগে উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জের কর্ণজোড়ায় খাদ্য ও সরবরাহ দফতর ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখায় এসইউসি পরিচালিত সংগ্রামী গণমঞ্চের উত্তর দিনাজপুর জেলা কমিটি। এ দিন কয়েকশো কর্মী-সমর্থক কয়েক বস্তা ধান পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানান এবং জেলা খাদ্য ও সরবরাহ আধিকারিককে স্মারকলিপি দেন।
ধান কেনা নিয়ে মহাকরণে এ দিন বৈঠক করেন খাদ্যমন্ত্রী। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মুখ্যসচিব, কৃষিসচিব এবং এফসিআই-এর কর্তারা। পরে খাদ্যমন্ত্রী জানান, এ পর্যন্ত ৪ লক্ষ ১৬ হাজার ৩৭১ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্থাকে ধান সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বেনফেড ১৫ হাজার, কনফেড ১৫ হাজার, নাফেড ১০ হাজার, ইসিএসসি ২ লক্ষ এবং এমসিসিএফ ১৫ হাজার মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করবে। খাদ্যমন্ত্রীর দাবি, নতুন সরকার গত বছরের তুলনায় ধান
সংগ্রহে এগিয়ে রয়েছে। গত বার জানুয়ারি পর্যন্ত ৩ লক্ষ ৯৭ হাজার মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ হয়েছিল। যদিও বিরোধী দলনেতার দাবি, ধান সংগ্রহের মাত্রা খুবই খারাপ। সরকার ফড়েদের কাছ থেকে ধান কিনছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ধান সংগ্রহের ক্ষেত্রে অনেক অভিযোগ আসছে। যেমন পঞ্চায়েত প্রধানদের দেওয়া কৃষকের শংসাপত্র নিয়ে ফড়েরা ধান বেচতে আসছে। বর্ধমানের গলসিতে এ রকম ৬টি ঘটনা ঘটেছে। ওই জেলার আউশগ্রাম, মঙ্গলকোটেও এ ধরনের অভিযোগ উঠছে বলে তিনি জানান।
এ বারের পরিস্থিতি অবশ্য অন্য আশঙ্কাও তৈরি করেছে। এক দিকে খরিফ ধানের দাম না পাওয়া, অন্য দিকে সার ও চাষের অন্য খরচ বেড়ে যাওয়ায় চাষিরা বোরো চাষে উৎসাহ হারাচ্ছেন বলে কৃষি অধিকারিকরা জানিয়েছেন। তাঁরা জানান, এ বার রাজ্যে ১৫ লক্ষ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়ে ছিল। কিন্তু সেটা কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
কৃষি দফতরের অফিসারদের বক্তব্য, বোরো চাষ এমনিতেই খরচ সাপেক্ষ। তার সঙ্গে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি, ইউরিয়া বাদে সমস্ত রকম সারের দাম গত দু’ বছরে তিন গুণ বেড়েছে। বেড়েছে খেত মজুরের পারিশ্রমিক। ফলে বোরো চাষে বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক বেড়ে গিয়েছে। খরিফ ধানের দাম না-পাওয়ার পরে স্বাভাবিক ভাবেই বোরো চাষ নিয়ে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। |
|
|
|
|
|