প্রেক্ষাপটে ধ্রুপদী খেয়ালের মূর্চ্ছনা। আর অডিও-ভিস্যুয়ালের পর্দায় সাদা-কালো ছবির নস্টালজিয়া। কখনও ক্রিকেট ব্যাট হাতে কিশোর মনসুর আলি খান পটৌডি, কখনও বা সিপিয়া রঙে পটৌডি আর শর্মিলা ঠাকুর। আর সেই স্মৃতিমুখর ছবিতে কখনও রঙিন সেফ আলি খান। বাবার সম্বন্ধে বলছেন, ‘ওঁকে অনেকটা আল পাচিনোর মতো মনে হত।’ স্মৃতি সততই সুখের!
গত বছর ৫ জানুয়ারি, স্বামী মনসুর আলি খান পটৌডির জন্মদিনে উপহার দেওয়ার জন্য ওই ছবি তৈরি করেছিলেন শর্মিলা ঠাকুর। মাত্র ৩৯০ দিনের ব্যবধানে সেই ‘জন্মদিনের উপহার’ই হয়ে গেল শ্রদ্ধার্ঘ্য। সোমবার সন্ধ্যায় মধ্য কলকাতার এক পাঁচতারা হোটেলের বলরুমে সেই ছবি দেখিয়েই শুরু হল ‘টাইগার পটৌডি স্মারক বক্তৃতা’। ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ ও ‘বেঙ্গল ক্লাব’-এর উদ্যোগে প্রথম বছরেই সেই বক্তৃতা দিতে পাকিস্তান থেকে কলকাতায় উড়ে এলেন ইমরান খান!
মিনিট সাতেকের ছবি শেষ হওয়ার পর জিন্স আর ব্লেজার পরা ষাট ছুঁইছুঁই উজ্জ্বল তরুণ ইমরানের সঙ্গে পটৌডির হরেক সাদৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দিলেন এবিপি সংস্থার প্রধান সম্পাদক অভীক সরকার, “দু’জনেই অক্সফোর্ডের স্নাতক। তবে কলেজ আলাদা। টাইগার ছিলেন বেলিয়ল কলেজে, ইমরান কেব্ল কলেজে।” দুই ক্যাপ্টেনের বর্ণাঢ্য চরিত্রের কথাও মনে পড়িয়ে দিলেন তিনি, “টাইগার বলেছিলেন, আমার বেনিফিট ম্যাচ করার দরকার নেই। তার বদলে বরং ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে ইমরানকে নিলাম করে যা টাকা উঠবে, আমাকে দিও। সেই কথা শুনে কয়েক বছর পরে এক ভারতীয় সাংবাদিককে ইমরানও বলেছিলেন, টাইগারকে অক্সফোর্ডের মেয়েদের মধ্যে নিলাম করছ না কেন? তাতেও ভাল টাকা উঠবে।” |
শুধু উচ্ছল, রঙিন হাবভাব? দু’জনের মধ্যে আরও একটি মিল ছিল। দু’জনেই নেতা হয়ে অন্যদের শ্রদ্ধা আদায় করে নিয়েছেন। “রাজনীতির নেতাদের সম্পর্কে কিন্তু এমন ভাবাটা দুষ্কর,” বলছিলেন প্রধান সম্পাদক।
পাকিস্তান তহরিক-ই-ইনসাফ’ দলের নেতা অবশ্য এখন ক্রিকেট জীবন পিছনে ফেলে রাজনীতির ‘নায়ক’ হওয়ার পথে। টি-২০ খেলা বন্ধ না করলে ভারতীয় ক্রিকেটের সমূহ সর্বনাশ জানিয়ে শেষে বললেন, “তাড়াতাড়ি এগুলি করুন। পাকিস্তানে আগামী ভোটে ‘তহরিক-ই-ইনসাফ’ জিতে কিন্তু সে দেশের ব্যবস্থা বদলে দেবে। বদলে দেবে সেখানকার ক্রিকেটকেও। এখন থেকে চেষ্টা না করলে কিন্তু ভবিষ্যতে এঁটে উঠতে পারবেন না।”
রাজনীতির কথা এখন থাকুক। পাকিস্তানের ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ বিশ্বকাপজয়ী দলের ক্যাপ্টেন এ দিন জানিয়ে গেলেন, ‘১৯৯০ সালে নিউ ইয়র্কে আমরা ভারতের বিরুদ্ধে ২০-২০ ফর্ম্যাটে একটা প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেছিলাম। সেখানকার ক্রিকেট-অজ্ঞ লোকেরা ভিড় করে দেখতে এসেছিল। তখন কেরি প্যাকারকে চিঠিও লিখেছিলাম,
যে সব দেশে ক্রিকেটের প্রচলন নেই, সেখানে এই রকম খেলা চালু করুন। এখন উল্টো ব্যাপার। ক্রিকেট-খেলুড়ে দেশরাই ওই ফর্ম্যাট নিয়ে নাচছে। বিপুল দর্শকের ভিড়, সঙ্গে বলিউডের গ্ল্যামার।
এ দিকে টেস্ট ম্যাচে স্টেডিয়াম ফাঁকা। মনে রাখতে হবে, টেস্ট ক্রিকেটেই খেলোয়াড়ের আসল পরীক্ষা।’ কে না জানে, মনসুর আলি খান পটৌডির অন্যতম পরিচয়: বিদেশের মাটিতে প্রথম টেস্টজয়ী ভারতীয় অধিনায়ক।
ক্রিকেট মাঠে ইমরানের আত্মপ্রকাশ সত্তরের দশকে। পটৌডি তাঁর আগের প্রজন্মের। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান সীমানা ভেঙে ক্রিকেটের যে পরম্পরা? ইমরান খান নিয়াজি জানিয়ে গেলেন, “আমার খুড়তুতো দাদা জাভেদ বার্কি পাকিস্তানের কনিষ্ঠতম ক্যাপ্টেন। ছোটবেলায় আমার দু’জন রোল-মডেল ছিল। বার্কি আর পটৌডি! বার্কি অক্সফোর্ডে টাইগারের সঙ্গে খেলত। প্রায়ই বলত, মনসুরের একটা চোখ নষ্ট না হলে সব রেকর্ড ভেঙে দিত।”
অক্সফোর্ড-স্নাতক বলছিলেন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথাও, “শিক্ষিত মনই সঠিক বিশ্লেষণ করতে পারে।” একটি অভিজ্ঞতাও শোনা গেল তাঁর কণ্ঠে। ’৭৯ সালের পাকিস্তান টিম এসেছে ভারতে। একই ঘরে দুই তরুণ ক্রিকেটার। জাহির আব্বাস ও ইমরান। জাহির আব্বাস দেশে ভাল ফর্মে ছিলেন। কিন্তু এখানে এসে ব্যর্থ। এক দিন বললেন, ‘আমার চোখটা বোধ হয় খারাপ হচ্ছে।’ পরের ম্যাচেও ব্যর্থতা। জানালেন, ‘আমার গ্রিপটা ঠিক পাচ্ছি না।’ তার পরেও ব্যর্থ। বললেন, ‘কেউ নির্ঘাত ব্ল্যাক ম্যাজিক বা তন্ত্রমন্ত্র করে আমার ফর্ম খারাপ করে দিয়েছে।’
অতএব শিক্ষার দরকার! ইমরান খানের বিশ্লেষণ: টাইগার অর্থ রোজগারের জন্য শুধু ক্রিকেটের ওপর নির্ভর করতেন না। ফলে তিনি ঝুঁকি নিতে পারতেন, নিজের মতো উচ্ছল থাকতে পারতেন। ক্রিকেটই যাদের জীবনের একমাত্র রুটিরুজি, সেই ‘শ্রমিক’রা কখনও ঝুঁকি নেয় না। টাইগার যদি ঝুঁকি না নেওয়ার নিরাপদ জীবনে থাকতেন? হয়তো আরও বেশি রান যোগ হত, কিন্তু জীবন তার উচ্ছলতা ও ঔজ্জ্বল্য হারাত। ঘাড় নেড়ে যেন নীরব সমর্থন জানালেন দর্শকাসনে বসে থাকা নাসিরুদ্দিন শাহ ও ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়।
ওই শিক্ষিত মনন থেকেই এ দিন ইমরানের টোটকা: অস্ট্রেলিয়ার ‘শিল্ড ক্রিকেট’-এর মডেল অনুসরণ করতে হবে। সারা দেশের ক্রিকেটারদের ছয়টি টিমে ভাগ করতে হবে। তার পর টি-২০ নয়, বরং ‘রণজি ট্রফি’র মতো তাদের মধ্যে দু’তিন মাস লাগাতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা! এ ভাবেই উঠে আসবে ভবিষ্যতের ‘টিম ইন্ডিয়া’। ২০-২০ তো ফাস্ট বোলারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেবে না। “আমি বল করার সময় উইকেট নয়, ব্যাটসম্যানের চোখ দেখতাম। ভয় পাচ্ছে? নিজেকে একটু গুটিয়ে নিয়েছে?” ফাঁস করলেন তিনি।
শেষ পর্বে মঞ্চে এলেন ‘আম্মা সাহিবা।’ এই নামেই ‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস’ বা ‘অপুর সংসার’-এর নায়িকাকে মঞ্চে ডাকলেন প্রধান সম্পাদক। শর্মিলা জানালেন, “শারজায় টাইগার কলাম লিখত, তখন ইমরানের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হত। মুম্বইয়ে আমাদের বাড়িতে এক বার এসেছিল। ওকে দেখার জন্য মেয়েদের যা ভিড়!”
ওটুকুই সব নয়। দাম্পত্য রহস্যও ফাঁস হল এ দিন, “এক দিন লেটকাট কাকে বলে, ভুল বলে ফেলেছিলাম। তার পর থেকে টাইগারের শর্ত ছিল, ক্রিকেট নিয়ে আমার কথা বলা চলবে না,” হাসলেন শর্মিলা। ক্রিকেট ক্যাপ্টেন থেকে নবাব থেকে সম্পাদক থেকে স্বামী থেকে উচ্ছল মানুষ...সব পটৌডিই যেন ধরা পড়লেন এ দিনের প্রথম স্মারক বক্তৃতায়।
স্মারক বক্তৃতাটি এই বছরেই শুরু হল। ঘটনাচক্রে এই বছরেই স্বামী বিবেকানন্দের ১৫০ ও চার্লস ডিকেন্সের ২০০ বছর পূর্তি। ডিকেন্সের ‘পিকউইক পেপার্স’ ছিল বিবেকানন্দের প্রিয় উপন্যাস। কে না জানে, সেখানেই ছিল ‘আল মাগ্লটন’ আর ‘ডিঙ্গবি ডেল’ নামে দুই দলের ক্রিকেট খেলার বর্ণনা! ‘গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলা ভাল’ বললেও এই উপন্যাস কোনও দিন এড়িয়ে যেতে পারেননি বিবেকানন্দ। ক্রিকেট এই শহরেরই খেলা!
শহরে প্রথম টাইগার পটৌডি স্মারক বক্তৃতা সেই ঐতিহ্যকেই যেন নতুন ভাবে মনে পড়িয়ে দিল। |