বাজেটে নতুন লক্ষ্য স্থির করা তো দূরস্থান, গত বছর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পেশ করা বাজেটের লক্ষ্যপূরণ করতেই এখন হিমশিম খাচ্ছেন দীনেশ ত্রিবেদী।
গত বার বাজেট পেশের সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জোর দিয়েছিলেন পরিকাঠামো উন্নয়নে। তখনই তিনি কবুল করেন, তাঁর আগের দেওয়া প্রতিশ্রুতির পুরোটা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। কিছুটা ঘাটতি থেকে গিয়েছে। আর দেড় মাসের মাথায় দীনেশ যখন তাঁর প্রথম বাজেট পেশ করতে চলেছেন, তখন দেখা যাচ্ছে দু’বছর আগের ঘাটতিটা রয়েই গিয়েছে। পরিকাঠামো প্রসারে নতুন লাইন পাতা, ‘ডাবলিং’ বা গেজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মমতা গত বাজেটে যা ঘোষণা করে গিয়েছিলেন, তার সিংহভাগই অধরা থেকে গিয়েছে। কাজ হয়েছে মাত্র ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। কিছু ক্ষেত্রে সামান্য বেশি। তবে যে শ্লথ গতিতে কাজ এগোচ্ছে তাতে ওই লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক ছোঁয়া যাবে না বলেই মনে করছে মন্ত্রক কর্তারা।
রেলমন্ত্রী হিসাবে মমতা কী ঘোষণা করেছিলেন এবং কী হয়নি? নিজের শেষ বাজেটে তিনি ১০৭৫ কিলোমিটার নতুন লাইন, ১০১৭ কিলোমিটার গেজ পরিবর্তন ও ৮৬৭ কিলোমিটার রেলপথে দ্বিতীয় লাইন পাতা তথা ‘ডাবলিং’-এর লক্ষ্যমাত্রা রেখেছিলেন। এ ছাড়া তাঁর প্রতিশ্রুতি ছিল, গত বাজেটে হাজার কিলোমিটার নতুন লাইনের মধ্যে যে ৩০০ কিলোমিটারের কাজ বাকি থেকে গিয়েছিল তা-ও শেষ করা হবে। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি তাতে গত বারের ঘাটতির সেই ৩০০ কিলোমিটার নতুন লাইন পাতার কাজই হয়তো শেষ হয়ে উঠবে না। |
|
কাজ-নামা |
সারা দেশে |
ঘোষণা |
নতুন লাইন |
১০৭৫ |
১৮০ |
গেজ পরিবর্তন |
১০১৭ |
২০১ |
ডাবলিং |
৮৬৭ |
২৪৯ |
পূর্ব রেল |
নতুন লাইন |
৭৮.৬ |
১৩ |
গেজ পরিবর্তন |
১২ |
হয়নি |
ডাবলিং |
৮৩.৮৫ |
২৪.৫ |
দক্ষিণ পূর্ব রেল |
ডাবলিং |
৩৮ |
হয়নি |
(দূরত্বের হিসেব কিলোমিটার) |
|
|
নতুন বছরের শুরুতে ১৭টি রেল-জোনের কাজের যে খতিয়ান বোর্ডের কাছে জমা পড়েছে তা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। দেখা যাচ্ছে চলতি আর্থিক বছরের প্রথম ন’মাসে নতুন লাইন, গেজ পরিবর্তন বা ‘ডাবলিং’-এর মতো বুনিয়াদি ক্ষেত্রগুলিতে কাজ থমকে গিয়েছে। ঘাটতি রয়েছে ইঞ্জিন ও কামরার উৎপাদনেও। রিপোর্ট বলছে, ওই বাজেটের পর থেকে এই পর্যন্ত নতুন লাইন পাতা গিয়েছে খুব সামান্যই। অথচ ওই দু’টি ক্ষেত্রে গত আর্থিক বছরে কিন্তু প্রায় ১৫০০ কিলোমিটারে লক্ষ্য ছুঁয়েছিল মন্ত্রক। চিত্রটি খুব একটা আশাপ্রদ নয় রেলমন্ত্রীর নিজের রাজ্যেই। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব রেলের অবস্থাও অন্য জোনগুলির মতোই। বাজেটের আগে সব জোনের জেনারেল ম্যানেজারদের সঙ্গে বৈঠকে এই পরিসংখ্যান সামনে আসায় ক্ষুব্ধ দীনেশ। কী ভাবে বাকি সময়ের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হতে পারে, সেটাই তিনি দেখতে বলেছেন রেল বোর্ড সদস্য (মেকানিক্যাল) সঞ্জীব হন্ডাকে।
মন্ত্রক খুব ভাল করেই জানে, ফি বছর যে শ’খানেকের বেশি নতুন ট্রেনের ঘোষণা হয়, তার জন্য রেলের পরিকাঠামোর উন্নয়ন সব থেকে জরুরি। এক রেলকর্তার কথায়, “প্রত্যেক বাজেটে নতুন-নতুন ট্রেনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। সেগুলির বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব হয়, যখন নতুন লাইন পাতা, ‘ডাবলিং’-এর মতো প্রাথমিক কাজগুলি ঠিকঠাক ভাবে হয়। তা না হলে রেলের গোটা পরিকাঠামো ভেঙে পড়বে।”
এখন প্রশ্ন হচ্ছে দীনেশ চাইলেও কি সম্ভব হবে লক্ষ্যমাত্রা ছোঁয়া?
মন্ত্রক মনে করছে, কাজের যা গতি, তাতে আসন্ন বাজেটের মধ্যে ওই লক্ষ্য ছোঁয়া কার্যত অসম্ভব। কেন? মন্ত্রকের একাধিক শীর্ষ কর্তার ব্যাখ্যা, বর্তমানে রেল মন্ত্রক কার্যত দিশাহীন। মন্ত্রকের অভিমুখ বা কাজের গতিপ্রকৃতি কী হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই খোদ শীর্ষ কর্তাদেরই। রেলমন্ত্রী বুলেট ট্রেনের মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনার উপর জোর দিচ্ছেন। সিঙ্গাপুরের সংস্থাকে দিয়ে ট্রেনে খাবার পরিবেশনের কথা ভাবছেন। কিন্তু তা করতে গিয়ে উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে নতুন লাইন পাতা, ‘ডাবলিং’ বা বৈদ্যুতিকরণের মতো প্রাথমিক কাজগুলি। অধিকাংশ রেল-কর্তা এটাই বুঝে উঠতে পারছেন না যে, বুলেট ট্রেন চালানো হবে, নাকি রেলের বুনিয়াদি পরিকাঠামোর উন্নয়ন করা হবে।
কাজে গতি না আসার পিছনে আর এক কারণ কী আর্থিক টানাটানি? মমতা কী তাঁর বাজেটে এই পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ রাখেননি?
মন্ত্রক বলছে, রেখেছিলেন। গত বাজেটে নতুন লাইন পাতার জন্য ৯৫৩৮ কোটি, ‘ডাবলিং’-এর জন্য ৫৪০৬ কোটি ও গেজ পরিবতর্নের জন্য ২৪৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন মমতা। রেলের এক কর্তার বক্তব্য, “অর্থ যথেষ্ট রয়েছে। কিন্তু প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছার।” গত কয়েক বছর ধরেই আর্থিক টানাটানি চলছে রেলে। কিন্তু তা সত্ত্বেও গত বছর ৭০০ কিলোমিটার নতুন লাইন পাতা সম্ভব হয়েছিল। ‘ডাবলিং’ ও গেজ পরিবর্তনেও লক্ষ্যমাত্রা ছোঁয়া গিয়েছিল। |