পার্টি কংগ্রেসের আগে ‘ঘুরে দাঁড়াল’ আলিমুদ্দিন! দলের অন্দরে।
প্রকাশ কারাট-আলিমুদ্দিন ‘দূরত্ব’ সিপিএমে সুবিদিত। সময়োপযোগী মতাদর্শগত দলিল নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে ‘চিনের প্রাচীর’ মাথা তুলেছে! মতাদর্শগত দলিলে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটি প্রস্তাব ঘিরে কেন্দ্রীয় কমিটিতে ভোটাভুটি হয়েছে এবং তাতে বিপুল ব্যবধানে হেরেছে
কারাট-শিবির! প্রস্তাবের বিপক্ষে
ভোট পড়েছিল ৬০। পক্ষে ৯। ভোটদানে বিরত এক।
সিপিএমের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ওই ঘটনাকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে কারাটের হার হিসাবেই দেখা হচ্ছে। কারণ, চিনের পার্টিকে এখন কমিউনিস্ট বা সমাজতন্ত্রী বলা যাবে না এই মর্মে প্রস্তাব গ্রহণ করাতে কেন্দ্রীয় কমিটির অন্দরে যাঁরা ‘সক্রিয়’ হয়েছিলেন, তাঁরা কারাট-অনুগামী বলেই দলে পরিচিত। প্রস্তাব মানতে অস্বীকার করে বঙ্গ ব্রিগেড। প্রস্তাবটি ভোটে তোলাও হয় তাদেরই আপত্তিতে। এবং ভোটে দেখা যায়, বঙ্গ ব্রিগেডের মত প্রায় সাতগুণ বেশি সমর্থন পেয়েছে কারাট-শিবিরের তুলনায়! সিপিএম সূত্রের খবর, প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশ, দিল্লি এবং উত্তরপ্রদেশের সদস্যেরা। কারাট-শিবিরের প্রতিনিধি হিসাবে পরিচিত হলেও কেরল ও তামিলনাড়ু ছিল বাংলার পাশে।
ওই ঘটনাকে এক দিকে খোদ সাধারণ সম্পাদকের ‘পরাজয়’ বলে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। অন্যদিকে দেখা হচ্ছে বুদ্ধ-পন্থীদের ‘জয়’ হিসাবে (যে হেতু সিপিএমে আপাতত চিনের ঝান্ডা রয়েছে পলিটব্যুরোর দুই সদস্য বুদ্ধবাবু এবং সীতারাম ইয়েচুরির হাতে)। পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতি হিসাবে কলকাতায় সদ্য অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকেই ওই ভোটাভুটি হয়েছে। সাধারণ সম্পাদকের মতাবলম্বী শিবিরের ভোটে হেরে যাওয়া স্বভাবতই সিপিএমের অন্দরে তোলপাড় ফেলেছে। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যেরা কলকাতা থেকে ফিরে গিয়েও ওই নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন।
দলের একাংশের ব্যাখ্যা, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি মেনে মতাদর্শের সঙ্গে সম্পর্কিত এমন এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভোটাভুটির মধ্যে ‘অস্বাভাবিক’ কিছু নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে গৃহীত মত সংখ্যালঘুরাও কার্যকর করবেন। এর আগে বি টি রণদিভের জীবদ্দশায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে গরবাচভ জমানা-সংক্রান্ত প্রস্তাবও এ ভাবেই কেন্দ্রীয় কমিটিতে পরাজিত হয়েছিল। কিন্তু দলের নীতি এবং মতাদর্শ নিয়ে যে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাই থাক, সাধারণ সম্পাদকের ‘একচ্ছত্র মত’ মানতে না-চেয়ে এ রাজ্যের সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটিতে যে কাণ্ড ঘটিয়েছে, তাকে কারাট-শিবিরের প্রতি ‘বড়সড় ধাক্কা’ হিসাবেই দেখছে দলের একটি বড় অংশ। পরিস্থিতি এখন এমন যে, পার্টি কংগ্রেসের আগে মার্চে কেন্দ্রীয় কমিটির শেষ বৈঠকও কলকাতায় হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
কারণ, বুদ্ধবাবু এখন ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভূমিকা পালন করছেন। তবে তার আগে ১০ মার্চ দিল্লিতে বসার কথা পলিটব্যুরোর।
সিপিএম সূত্রের খবর, মতাদর্শগত দলিল নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিতর্ক চলাকালীন অন্ধ্রের এক নেতা বলেন, চিনে সংস্কার কর্মসূচি মানুষের কাজে লেগেছে ঠিকই। কিন্তু একই সঙ্গে বৈষম্য, দুর্নীতির মতো কিছু ‘স্ব-বিরোধিতা’রও জন্ম দিয়েছে। চিনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)-ও এই বিষয়ে অবহিত। তবে ‘তাদের কমিউনিস্ট বা সমাজতন্ত্রী বলা যাবে কি না, ভবিষ্যতই তার উত্তর দেবে’ এই কথা দলিলে রাখার প্রস্তাব দেন অন্ধ্রের ওই নেতা। কারাট-ঘনিষ্ঠ পলিটব্যুরোর এক সদস্য প্রস্তাবের পক্ষে জোরালো সমর্থন দেন। কিন্তু রুখে দাঁড়ায় বাংলা। এ রাজ্য থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য দাবি করেন, চিন সম্পর্কে ওই মূল্যায়ন মানা যাবে না। বিষয়টি তখন ভোটে তোলার সিদ্ধান্ত হয়।
কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, “পশ্চিমী দুনিয়ায় অর্থনৈতিক সঙ্কটের জেরে পুঁজিবাদ যখন তীব্র সমালোচনার মুখে, সেই সময়েই চিন সম্পর্কে এমন প্রস্তাব যথেষ্ট বিস্ময়কর! সোভিয়েতের পতনের পরে বৃহত্তম যে কমিউনিস্ট পার্টি বৃহত্তম সরকার চালাচ্ছে, সেটা সিপিসি-ই। বিশেষত, গত কয়েক বছরে তাদের জনমুখী কর্মসূচি রূপায়ণ গোটা পৃথিবীর কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে।” উদাহরণ ১৯৮৪-র অলিম্পিকে যে চিন শুধু ব্রোঞ্জ পেয়েছিল, ২০০৮-এর বেজিং অলিম্পিকে তারাই চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে! এ থেকে কিছু শেখার নেই?
দলের অন্দরে বুদ্ধবাবুদের মত, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়ন এবং বাজারের শক্তিকে (মার্কেট ফোর্সেস) সামলানোর ক্ষেত্রে চিন যা করেছে, তা অবশ্যই শিক্ষণীয়। অর্থনীতির ক্ষেত্রে তারা বেসরকারি বিনিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছে। যদিও জমির মালিকানা রাষ্ট্রেরই আছে। চিনের মানুষের ‘স্বজাতির প্রতি গর্ব’কে উন্নয়নের কাজে লাগানো হয়েছে সুচারু ভাবে। উন্নয়নের প্রশ্নে চিনের কাছ থেকে এ দেশের কমিউনিস্টদের শিখতেই হবে। প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের আমলে চিনের দেং জিয়াও পিঙের আদলেই পুঁজি এবং শিল্পের জন্য সওয়াল করতেন বুদ্ধবাবু। পক্ষান্তরে, কারাট-অনুগামীদের মত, অর্থনীতির ক্ষেত্রে ‘খোলা হাওয়া’ আনতে গিয়ে সিপিসি-র ‘কমিউনিস্ট চরিত্র’ ধাক্কা খেয়েছে। যাকে বলা হত ‘সোশ্যালিজম উইথ চাইনিজ ক্যারেক্টারিস্টিক্স’, তা অচিরেই ‘নিও-লিবারেলিজম উইথ চাইনিজ ক্যারেক্টারিস্টিক্স’-এ পর্যবসিত হবে! মনমোহন সিংহদের কংগ্রেসের সঙ্গে এই চিনের বিশেষ তফাত নেই বলেই মনে করে সিপিএমের ‘কট্টর’ অংশ।
আবার অন্য অংশের প্রশ্ন, চিন নিয়ে এত আপত্তি থাকলে সিপিসি-র সঙ্গে ‘পার্টি-টু-পার্টি’ বিনিময় কর্মসূচির আওতায় বছর বছর সে দেশে সিপিএম লোক পাঠায় কেন? গত বছরও ইয়েচুরি, শ্রীদীপ ভট্টাচার্যেরা চিনে গিয়েছেন। অন্ধ্রের প্রতিনিধিরাও সফর করেছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি দলে পাঠানো হয়েছে ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তরুণ নেতাদের। কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের বক্তব্য, “এ বার সিপিসি-র সঙ্গে সিপিএমের দূরত্ব বাড়ানোর কোনও বার্তা কি দলের শীর্ষ স্তর থেকে দেওয়ার চেষ্টা হবে?”
পার্টি কংগ্রেস উপলক্ষ্যে সিপিএমের মধ্যে এখন চিন এবং লাতিন আমেরিকা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। কিউবার পরে ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া, ব্রাজিল, পেরু, নিকারাগুয়া, উরুগুয়ে, ইকুয়েডরের মতো লাতিন আমেরিকার দেশগুলি যে ভাবে ‘মার্কিন আধিপত্যে’র বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, অস্ত্র ছেড়ে গণতন্ত্রের পথেই মানুষের মুক্তির পথে এগোনোর কথা বলছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এবং সমবায় প্রথার গুরুত্ব বজায় রেখে ‘বিকল্প অর্থনীতি’কে সমৃদ্ধ করছে, তা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে বলে দলের একাংশের মত। বিশেষত, বহুদলীয় গণতন্ত্রে ভোটে জিতে ক্ষমতা দখলের পথটি ভারতের পরিস্থিতির সঙ্গে মিলে যায়। তবে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রাক্তন সদস্য সৈফুদ্দিন চৌধুরীর মতো নেতারা বলছেন, “লাতিন আমেরিকার এক একটা দেশ এক এক রকম ভাবে চলছে। তবে কিছু সমাজতান্ত্রিক ধারা নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু ভারতে এ নিয়ে বিতর্কের কোনও মানেই হয় না! গণতান্ত্রিক পথে সমাজতন্ত্রকে প্রসারিত এবং উৎকর্ষে পৌঁছনোর যে সুযোগ সিপিএমের ছিল, তারা তা হারিয়েছে!”
মতাদর্শগত দলিল শেষ পর্যন্ত ভারতের ‘নিজস্ব অভিজ্ঞতা’র কথাই বলবে। কিন্তু পার্টি কংগ্রেসের আগে কারাটের ‘অভিজ্ঞতা’ আপাতত মধুর নয়! |