সলমন রুশদির আরও একটু ‘নরম’ হওয়া উচিত ছিল। “আমি কোনও বই নিষিদ্ধ করা সমর্থন করি না। কিন্তু প্রতিটি দেশের একটি নিজস্ব মূল্যবোধ রয়েছে। উদারনীতিকরা বলতেই পারেন, রাস্তায় নগ্ন হয়ে দৌড়নো অপরাধ নয়। আমিও তাতে বিশ্বাস করি। কিন্তু তা বলে আপনি-আমি কি আগামী কাল নগ্ন হয়ে দৌড়ব?”
রবিবার এক পাঁচতারা হোটেলে আড্ডায় প্রশ্ন করলেন চেতন ভগত। ‘ফাইভ পয়েন্ট সামওয়ান’ বা ‘থ্রি মিসটেকস অফ মাই লাইফ’-এর লেখকই এ দিন কলকাতা সাহিত্য উৎসবে জনপ্রিয়তম তারকা, তাঁর অধিবেশনের সময় ৭০০ আসনের ইউবিআই অডিটোরিয়ামের দরজায় রক্ষীদের দাঁড়াতে হল। ভিড়ে ভর্তি অডিটোরিয়াম, আর লোক ঢুকতে দেওয়া যাবে না।
|
বইমেলায় চেতন ভগত।
নিজস্ব চিত্র |
চেতন এ দিন রুশদির সঙ্গে তাঁর টুইটার-যুদ্ধে ইতি টেনে দিয়েছেন। “নিষিদ্ধ লেখকদের অযথা নায়ক বানিয়ে লাভ নেই,” বলেছিলেন জয়পুরে। তার পরেই গত শনিবার রাতে চেতনকে সরাসরি টুইট করে রুশদি জানিয়েছিলেন, ‘চেতন, আমার মতো লোকেরা উদারনীতিক চরমপন্থী। মৌলবাদীদের মতোই খারাপ।’ চেতনের পদবী নিয়ে ঠাট্টাও করেছিলেন, ‘আই অ্যাম বিইং ভ্যাগার্ড।’ উত্তরে চেতনের পাল্টা খোঁচা: ‘বিতর্ক থেমেছে, দেশ এগিয়ে চলেছে, কিন্তু কেউ কেউ নিজেকে অবহেলিত বোধ করছেন। তাই ব্যক্তিগত আক্রমণ। শান্তি!’ একান্ত আলাপচারিতায় সেই প্রসঙ্গ তুলতেই হাসলেন চেতন, “আমার মনে হয়, উদারনীতিক এবং মৌলবাদী দু’পক্ষেরই একসঙ্গে আলাপ-আলোচনায় বসে সমঝোতায় আসা উচিত। সব লেখকই ভাবেন, আমার আইডিয়া অসাধারণ! কিন্তু যদি কেউ তাতে আহত বোধ করেন? যদি তৈরি হয় বিপজ্জনক পরিস্থিতি? সঠিক পরিবেশ-পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করতে হয়। ১৫ বছর আগেও ভারতীয় সিনেমায় চুমু খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল, এখন নয়। আমি একটি গণতান্ত্রিক পরিসরের কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু যে ভাবে খোঁচা খেলাম, মনে হয়, সকলেরই বাক-স্বাধীনতা রয়েছে, আমার নেই।” এই সাক্ষাৎকারের কয়েক মিনিট বাদে ইউবিআই অডিটোরিয়ামে বললেনও, “আমি কারও নিন্দা করি না। ইস্যুর সমালোচনা করো, ব্যক্তির নয়।”
রুশদির সমর্থনে হরি কুঞ্জরু, অমিতাভ কুমারেরা যে ভাবে ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ থেকে পাঠ করেছিলেন, তাকেও সমর্থন করেন না চেতন। “ওই রকম প্রতিবাদের মানে, আয়োজকদের বিপাকে ফেলা। এই যে বুকসেলার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স গিল্ড আমাকে এখানে ডেকে এনেছেন, আমি কি হঠকারিতার বশে তাঁদের বিপাকে ফেলতে পারি? এখন তো সব মিটে গিয়েছে। তা হলে ‘স্যাটানিক ভার্সেস’-এর নিষেধাজ্ঞা তোলার জন্য আন্দোলন করছেন না কেন ওঁরা? জয়পুরে যা হয়েছে, দেশের পক্ষে লজ্জার। প্রথমে রাজনীতির খেলা, তার পর মৌলবাদী বনাম উদারনৈতিক তামাশা। কেউ এতটুকু জায়গা ছাড়লেন না। সকলেই যেন জোর করে বলতে থাকলেন, আমিই ঠিক!”
‘ওয়ান নাইট অ্যাট কল সেন্টার’-এর লেখক এ রকমই। সোজাসাপ্টা, স্পষ্টবাদী। আইআইটি, আইআইএম-এর স্নাতক, অতঃপর ‘ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার’। এখন চাকরি ছেড়ে পুরো সময়ের লেখক। বই বেরনোর সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ড বিক্রি। ‘টাইম’ পত্রিকার ১০০ জন প্রভাবশালী লোকের তালিকাতেও তিনি। “ভারতীয় ইংরেজি লেখক এবং সমালোচকেরা একটু নাক-উঁচু এবং মৌলবাদী গোছের। তাঁরা আমাকে পাত্তা দেন না, কিন্তু বিদেশে অত নিন্দামন্দ হয়নি,” বললেন চেতন।
সেই সঙ্গে এখন তো চেতন ‘মোটিভেশনাল স্পিকার’ও বটে। কয়েক মাস আগে শহরে ওই রকম একটি বক্তৃতাও দিতে এসেছিলেন। লোককে উদ্দীপ্ত করার জন্য বক্তৃতা? “আমি অন্য ভাবে বলি। ধরুন মা-বাবা সব সময় বলেন, ‘লেখাপড়া করো’। আমি বলি, পরে প্রেম। আগে লেখাপড়াটা করে নিও।”
আর এখানেই ৩৮ বছর বয়সী চেতন ভগতের তারুণ্য-সংযোগ! সব সময় তরুণদের ভাষায় কথা। কলকাতা শহরে তাঁর শ্বশুরবাড়ি। স্ত্রী অনুষা তামিল কন্যা, আমদাবাদ আইআইএমে পড়ার সময় থেকে প্রেম। চেতনের ‘টু স্টেটস: দ্য স্টোরি অফ মাই ম্যারেজ’ উপন্যাস সেই অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতেই। অনুষার মা-বাবা দীর্ঘকাল কলকাতার বাসিন্দা। “আমার শ্বশুরবাড়ি কলকাতাতেই, আমি আপনাদের জামাই,” ইউবিআই অডিটোরিয়ামে অধিবেশনের শুরুতে বাংলায় বললেন চেতন।
বক্তৃতার মাঝে এল ‘চেঞ্জ’ বা ‘পরিবর্তন’ শব্দটাও। “তোমাদেরই এই সমাজে পরিবর্তন আনতে হবে। রাজনীতিকরা কিন্তু আসল নেতা নন। তাঁরা সবাই বলেন, ঠিক হ্যায়! যেমন চলছে চলুক। পরিবর্তন দরকার নেই। অন্যকে গালিগালাজ করে পরিবর্তন আনা যায় না, মানুষকে ভালবাসতে হয়, তাদের মনে বিশ্বাস জন্মাতে হয়,” ভক্তদের বললেন তিনি। সাহিত্য উৎসবে এ দিন আরও অনুষ্ঠান ছিল। কখনও ‘বেস্টসেলার’ নিয়ে আমিশ ত্রিপাঠী, কখনও বা বাংলা গান নিয়ে চন্দ্রিল-অনিন্দ্য-অনুপম রায়। কিন্তু একমাত্র চেতনই এ দিন পেলেন ৭০০ আসনের প্রেক্ষাগৃহ এবং প্রতি সেকেন্ডে দর্শকদের মোবাইল-ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ এবং হাততালি।
“আমি আশি শতাংশ বিনোদন দিই। বিনোদন দেওয়াই আমার প্রাথমিক কাজ,” বলে গেলেন লেখক। |