পর্যটনশিল্পের পরিকাঠামো সেই তিমিরে
হরমপুর-লালবাগ জুড়ে এখন কেবলই অচেনা মুখের ভিড়। হাজারদুয়ারি মিউজিয়াম সূত্রে জানা গিয়েছে, শনিবার প্রায় ১০ হাজার মানুষের ভিড় ছিল। বহরমপুরের এক হোটেল মালিক চন্দন সরকার বলেন, “এই ছুটিতে কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তের ও লাগোয়া শহরতলি থেকে পর্যটক বেড়াতে আসায় বহরমপুর-লালবাগ যেন মিনি কলকাতা। এ ছাড়াও বিভিন্ন জেলার পর্যটকদের ভিড়ে কোনও হোটেলেই ঘর ফাঁকা ছিল না।” একই কথা বলেন লালবাগের এক হোটেল মালিক আশিসকুমার রক্ষিত। তাঁর কথায়, “গত চার দিনে লালবাগের সব হোটেলেই ছিল পর্যটকদের ঠাসা ভিড়।” সঙ্গে পিকনিক করতেও ভিড় জমেছে লালবাগের বিভিন্ন পার্কে।

প্রশাসন ও পুরসভাও উদাসীন
পর্যটকদের কথায় উঠে এসেছে প্রশাসন ও পুরসভার উদাসীনতারও দিকটিও। তাঁদের কথায়, পর্যটন শিল্প নিয়ে পুরসভা-প্রশাসনের কোনও ভাবনা-চিন্তা নেই। মুর্শিদাবাদ নগর উন্নয়ন কমিটির কর্ণধার এ আর খান বলেন, “গত ১০ বছরে মুর্শিদাবাদে নতুন কোনও রাস্তা তৈরি হয়নি। সাফ-সুতরো করার পাশাপাশি রাস্তাঘাট চওড়া করার প্রয়োজন রয়েছে, তাও হচ্ছে না। প্রয়োজনীয় শৌচাগারের অভাব রয়েছে। পানীয় জলের কোনও ব্যবস্থাও নেই। প্রশাসন চেষ্টা করলেও রাজনীতির কচকচানি রয়েছে। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে জনপ্রতিনিধিদেরও দায় রয়েছে। কিন্তু তাঁদের ভূমিকাও হতাশজনক।” লালবাগ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, “পর্যটন উন্নয়ন নিয়ে কম কথা হচ্ছে না। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। নোংরা রাস্তাঘাট, যত্রতত্র ঘোড়ার মলমূত্র পড়ে রয়েছে।” তবে পর্যটন মরশুম শুরুর আগে লালবাগ মহকুমা প্রশাসন সব মহলকে নিয়ে বৈঠকেও করে। কিন্তু তা কার্যকরী হচ্ছে কিনা, সে ব্যাপারে প্রশাসনের উদাসীনতা রয়েছে বলে অভিযোগ। সন্ধ্যার পরে হাজারদুয়ারি ও ইমামবাড়া চত্বর অন্ধকারে ডুবে থাকছে। উদাসীন লালবাগ পুর-কর্তৃপক্ষ। ফলে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন বহিরাগত পর্যটকরা।” হাজারদুয়ারির পিছন দিকের পাঁচিল লাগোয়া জায়গায় পর্যটকদের ফেলে যাওয়া নোংরা-আবর্জনা স্তূপাকার হয়ে পড়ে থাকে। পুরসভা বা প্রশাসন কেউই এখন পর্যন্ত তা পরিষ্কার করেনি। মুর্শিদাবাদের পুরপ্রধান সৌমেন দাসের দাবি, “প্রতি দিনই ওই জায়গা পরিষ্কার করে দেওয়া হয়। তবে রবিবার ছুটি থাকায় জায়গাটি অপরিস্কার হয়ে রয়েছে। সোমবার তা সাফ-সুতরো করে দেওয়া হবে।” স্বপনবাবু বলেন, “আমাদের জায়গা দেওয়া হলে সরকারি অর্থের প্রয়োজন হবে না, আমরা নিজেদের উদ্যোগে শৌচালয়, পানীয় জল ও স্নানের ঘর তৈরি করে দেব।”

পর্যটকদের অভিযোগ
কিন্তু পর্যটন স্বাচ্ছন্দ্যের দিকটি মুর্শিদাবাদে এখনও উপেক্ষিতই রয়ে গিয়েছে বলে জানান কলকাতার লেকটাউনের বাসিন্দা বেসরকারি সংস্থার কর্মী আকাশলীনা চট্টোপাধ্যায়। তাঁর সাফ কথা, “দু’দিনের ছুটি কাটানোর পক্ষে মুর্শিদাবাদ আদর্শ জায়গা। কলকাতা থেকেও খুব একটা দূর নয়। ট্রেন ও বাসের সুবিধাও রয়েছে। কিন্তু এখানে এসে খুব হতাশ হয়েছি। হোটেল কর্মী থেকে টাঙ্গাওয়ালা--সকলেরই পেশাদার মানসিকতার অভাব রয়েছে। পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্যের দিকটি সেখানে অনুপস্থিত।” মালদহের পর্যটক শওকত জামান বলেন, “আমি যে হোটেলে ছিলাম, সেখানে খাবারের কোনও ব্যবস্থা ছিল না। পর্যটকদের ভিড় থাকায় অন্য হোটেলে জায়গা না পেয়ে এমন হোটেল নিতে বাধ্য হয়েছিলাম যেখানে খাবারের ব্যবস্থা ছিল না।” এদিকে পর্যটকদের ভাল পরিষেবা দেওয়ার ব্যাপারে হোটেল মালিকদের নিয়ে বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু ওই বৈঠকে অনেক হোটেল মালিকই হাজির ছিলেন না। ফলে হোটেল মালিকদের মধ্যে ‘সমন্বয়’ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। উপেক্ষিতই রয়ে গিয়েছে পর্যটক পরিষেবা।

আঁধার কাটেনি লালবাগে
দীর্ঘ দিন ধরে প্রশাসনিক স্তরে ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’-এর মধ্য দিয়ে মুর্শিদাবাদের ইতিহাসের কাহিনি দেখানোর পরিকল্পনা হলেও তা প্রতিশ্রুতিতেই রয়ে গিয়েছে। অন্য দিকে ফুলের গাছ লাগিয়ে শহরের এলাকার সৌন্দর্যায়ন বাড়ানোর কথাও বলেন অনেকে। আশিসবাবু বলেন, “সেক্ষেত্রে প্রশাসনের তরফে জায়গা দেওয়া হলে রাস্তার ধারে ফুলের গাছ লাগিয়ে তারের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হবে। সেখানে আলোরও বন্দোবস্ত থাকবে। এভাবে শহর জুড়ে গাছ লাগানো হলে শহরের সৌন্দর্য বাড়বে।” জিয়াগঞ্জ সংগ্রহশালার দায়িত্বপ্রাপ্ত মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “হাজারদুয়ারি সংগ্রহশালার চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার উপরে জোর দেওয়ার জন্য বলেছি। কেননা, হাজারদুয়ারি প্রাসাদ ও সংগ্রহশালা দেখার জন্য পর্যটকেরা ভিড় করেন, তার চারপাশ নোংরা থাকলে দশর্র্নার্থীরা মুখ ফিরিয়ে নেবেন।” সেই সঙ্গে মুর্শিদাবাদ থেকে জিয়াগঞ্জে সংগ্রহশালা পর্যন্ত টাঙা চালানোর ব্যাপারে প্রশাসনের উদ্যোগী হওয়া উচিত বলেও মৌসুমীদেবী মনে করেন। পর্যটনের উন্নয়নের স্বার্থে হাজারদুয়ারিকে কেন্দ্র করে মুর্শিদাবাদ পুর-এলাকাকে ‘ফ্রি লোডশেডিং জোন’ হিসেবে ঘোষণা করার দাবিও উঠেছে। সেই সঙ্গে কোনও কারণে দীর্ঘ ক্ষণ লোডশেডিং হলে, তার আগে মাইকে প্রচার করার পাশাপাশি মুর্শিদাবাদ পুর-এলাকায় যানজট রুখতে আস্তাবল মোড়, হাসপাতাল রোড, চক ও রেজিস্ট্রি অফিস মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ প্রহরার দাবি তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এ ছাড়াও দক্ষিণ দরওয়াজা থেকে তোপ ঘাট পর্যন্ত ভাগীরথীর পাড় বরাবর সৌন্দর্যায়নের ব্যাপারে প্রশাসনিক স্তরে গাফিলতি রয়েছে। আরও বেশি পর্যটক আসা মানেই পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন পেশার মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হবে। তাতে চাঙ্গা হবে জেলার অর্থনীতি।

পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়ন দাবি
পর্যটকদের পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকলেও বিদেশি পর্যটকেরা মুর্শিদাবাদে বেড়াতে আসার ক্ষেত্রে আগ্রহী হচ্ছে। পলাশি হয়ে লালবাগ বা জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জের ভাগীরথীর পাড় বরাবর দর্শনীয় স্থান নিয়ে ‘কনডাক্টেড ট্যুর’-এর ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত করা গেল না। এ ছাড়াও হাজারদুয়ারি থেকে কলকাতা যাওয়ার সরাসরি কোনও বাস নেই। পর্যটকদের ভিড় বাড়ায় বেড়ে গিয়েছে বিভিন্ন গাড়ি ভাড়াও। ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ী অনির্বাণ বিশ্বাস বলেন, “ঈদের পর থেকে পর্যটকেরা মুর্শিদাবাদ বেড়াতে আসতে শুরু করেছেন। অধিকাংশ পর্যটক বহরমপুরের হোটেলে থেকে লালবাগ ঘুরতে যান। সেক্ষেত্রে তাঁরা গাড়ি নিয়েই ঘুরতে যান। কিন্তু রাস্তাঘাটের কারণে গাড়ি ভাড়া অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে।” আগে অ্যাম্বাসাডরে ৫০০ টাকা নিলেও এখন সেখানে ৭০০ টাকা ভাড়া চাইছে। তবে দুর্গাপুজোর সময়ে সপরিবারে প্রতিমা দর্শনের জন্য অধিকাংশই গাড়ি ভাড়া করেন। এতে অর্থিক দিক থেকে লাভবান হন পরিবহণ শিল্পের সঙ্গে জড়িত সকলেই।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.