|
|
|
|
ফলক উন্মোচন প্রণবের |
বিবেক-বাণীর মঞ্চ ঘিরে বিশ্বজয়ের গৌরব-স্মৃতি |
অগ্নি রায় • শিকাগো |
একশো উনিশ বছরের ও-পার থেকে ভেসে আসছে সাড়ে ছ’হাজার আপ্লুত নর-নারীর করতালির আওয়াজ!
সেই করতালি, যা চলেছিল টানা দু’মিনিট! যা নিয়ে কত কিংবদন্তী আর গৌরবগাথা। দৃপ্ত সন্ন্যাসীর অবশ্য তখন ‘কানে তালা’ ধরে গিয়েছিল।
এই সেই স্মৃতিবিজড়িত ‘শিল্পপ্রাসাদ।’ সেই শীতার্ত শিকাগো। আর্ট ইনস্টিটিউট অফ শিকাগোর ফুলেরটন হল। উজ্জল মঞ্চটির ঠিক সামনে দাঁড়িয়েই ‘বিশ্বজয়’ করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। এই সেই মঞ্চ, যেখানে ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ঠিক আগে এসে ‘চিত্রা’ পাঠ
করে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন বিবেকানন্দকে। জীবদ্দশায় যদিও দুই যুগন্ধর পুরুষের পরিচয় হয়নি সে ভাবে।
কিন্তু তাতে কী এসে যায়!
বহু যুগ আগে শিকাগো মিলিয়েছিল তাঁদের। আজও আবার মেলালো। এই ‘ধর্মসভাঘরে’ একই সঙ্গে বিবেকানন্দের স্মৃতিফলক উন্মোচন ও রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনী (দীঘ আশি বছর পরে তাঁর ছবির আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর এতবড় আয়োজন করা গেল বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্তারা) উপলক্ষে যুগপৎ শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করতে এসে দৃশ্যতই অভিভূত কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। “জীবনে এমন মুহূর্ত বেশি আসে না।” ঘরোয়া আলোচনায় জানিয়েছেন এই প্রবীণ নেতা। আর প্রকাশ্যে ওই মঞ্চটিতে দাঁড়িয়ে প্রণবাবু বলেছেন, “এখানে দাঁড়িয়ে নিজের চিন্তাকে ভাষা দিতে পারছি না আমি।” |
|
বিবেকানন্দের সেই স্মৃতিফলক। ছবি: অগ্নি রায় |
একাকার, সব একাকার। মঞ্চের পিছনের স্ক্রিনে সাদা-কালোয় চলছে ১১৯ বছর আগের ছবিগুলোর মন্তাজ। ব্রাহ্মসমাজের প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, জৈনসমাজের বীরচাঁদ গাঁধী, অ্যানি বেসান্তের সঙ্গে মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন গৈরিকবসন সন্ন্যাসী, বুক চিতিয়ে। হাতে একতাড়া কাগজ। হয়তো বক্তৃতামঞ্চ থেকে নামার পরের ছবি। কারণ বক্তৃতা শুরুর আগে যে তাঁর ‘বুক দুরদুর’ করছিল, এবং ‘জিহ্বা শুষ্কপ্রায়’ হয়ে গিয়েছিল, সে কথা নিজেই লিখে গিয়েছেন বিবেকানন্দ। এতটাই ‘ঘাবড়ে’ গিয়েছিলেন যে, তিনি নাকি ‘পূর্বাহ্নে বক্তৃতা করার ভরসা’টুকু করতে পারেননি! কেননা সকলেই বক্তৃতা প্রস্তুত করে এনেছিলেন। তিনি করেননি! ‘দেবী সরস্বতীকে প্রণাম করে’ অগ্রসর হয়েছিলেন আন্তর্জাতিক শ্রোতৃমণ্ডলীর সামনে।
আজকের অনুষ্ঠানের বক্তৃতায়, এবং তার আগে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে (যেখানে আজ বিবেকানন্দ চেয়ারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হল) কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী মনে করিয়ে দিয়েছেন এক ঐতিহাসিক সমাপতনের কথা। বিবেকানন্দের সেই যুগান্তকারী বক্তৃতার তারিখটি ছিল ‘নাইন-ইলেভেন!’ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার তখন তৈরি হয়নি। ওসামা বিন লাদেনও না। কিন্তু সভ্যতায় ‘মহামারী’র কথা ছত্রে ছত্রে বলে গিয়েছিলেন স্বামীজি। প্রণববাবু বলেন, “দূরদ্রষ্টা স্বামীজি, এই তারিখটিতে আমেরিকার মাটিতে দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তৃতায় আমেরিকাবাসীকে সতর্ক করে গিয়েছিলেন। আজ তাঁর সে সব কথা আবার মনে করার সময় এসেছে।” বক্তৃতায় বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘আমি আশা রাখি... ধর্মীয় হানাহানি ও একবগ্গা মৌলবাদী চিন্তা-ভাবনার অবসান সূচিত হবে। ...অবসান ঘটবে ধর্মকে কেন্দ্র করে মানুষে-মানুষে সমুদয় অসদ্ভাবের।’
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এই স্মৃতিফলকের জন্য ১১৯ বছর অপেক্ষা করতে হল কেন?
আজ আবেগের স্মৃতিমঞ্চে দাঁড়িয়ে সে প্রশ্ন আঁকড়ে থাকতে চাইছেন না প্রণববাবু কিংবা আমেরিকায় নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত নিরুপমা রাও, অথবা শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দীপেশ চক্রবর্তীরা। বরং যেটুকু হয়েছে,ওঁরা তা নিয়েই এগোতে চাইছেন। স্থির হয়েছে, বিবেকানন্দের সার্ধ শতবর্ষ উপলক্ষ্যে আগামী চার বছর ধরে চলবে বিভিন্ন স্মরণ-অনুষ্ঠান। শিকাগো আর্ট ইনস্টিটিউটের নেতৃত্বে। এ জন্য পাঁচ লক্ষ ডলার দিয়েছে ভারত। ইনস্টিটিউটের তরফে দেওয়া হয়েছে পৌনে দু’লক্ষ ডলার।
প্রথমেই যেটা বলছিলাম। ১১৯ বছরের করতালিধ্বনি আজও ঝড় তুলছে আমেরিকাবাসীর মনে! |
|
|
|
|
|