ডনের শহরে ভারতীয় ক্রিকেটের সূর্য অস্ত গেল শনিবার সকালে। আর সে দিনই বিকেলে অস্ট্রেলিয়ার আর এক শহরে ভারতীয় খেলাধুলোকে মহাগর্বিত করল কলকাতায় বেড়ে ওঠা এক টেনিস প্লেয়ার। তাও কিনা ৩৮ বছর বয়সে, খেলোয়াড়জীবনের প্রত্যন্তে!
লিয়েন্ডার আদ্রিয়ান পেজ।
চেক সঙ্গী রাদেক স্টেপানেককে নিয়ে গত সাত দিনে বিশ্বের তিন, দুই এবং এক নম্বর জুটিকে হারিয়ে লিয়েন্ডার জীবনের প্রথম অস্ট্রেলীয় ওপেন ডাবলস খেতাব পেল। এ দিন ঘণ্টা দেড়েকের ফাইনালে ‘টিম লিয়েন্ডার’-এর বিশ্বসেরা ব্রায়ান ভাইদের জুটিকে ৭-৬ (৭-১), ৬-২ হারানো টিভি-তে দেখতে দেখতে বারবার মনে হচ্ছিল, একেই বলে জেদ! অধরা কিছুকে পাওয়ার লক্ষ্যে শেষ পর্যন্ত সেটার পিছনে লেগে থাকার প্রতিজ্ঞা। প্রথম সেটের টাইব্রেক আর দ্বিতীয় সেটে তো বব-মাইক, জমজ ভাইদের উড়িয়েই দিয়েছে লিয়েন্ডাররা। |
অস্ট্রেলীয় ওপেনের ডাবলস ফাইনাল জেতার পরে চেক সঙ্গী
রাদেক স্টেপানেকের কোলে লিয়েন্ডার পেজ। শনিবার মেলবোর্নে। ছবি: এ পি |
অথচ ওদের জুটির সম্মিলিত বয়স ৭২ বছর! স্তম্ভিত হয়ে দেখছিলাম, দু’জনেই গোটা ম্যাচে কী অসাধারণ রিটার্ন করল। অজস্র দুর্দান্ত ভলি মারল। ডাবলসের রাইট-লেফ্ট কোর্ট... ডিউস-অ্যাডভান্টেজ কোর্টের সব তত্ত্ব-টত্ত্ব সেখানে উধাও। কখনও লিয়েন্ডারের মতোই নেটের সামনে অনবদ্য রিফ্লেক্স দেখাচ্ছে স্টেপানেক। আবার কখনও বেসলাইন থেকে দুর্দান্ত ব্যাকহ্যান্ড রিটার্ন মারছে লিয়েন্ডার। আট বছর আগে ২০০৪-এ স্টেপানেককে নিয়ে ফ্লোরিডায় এটিপি খেতাব জিতেছিল লিয়েন্ডার। এত বছর পরে ফের জুটি বেঁধে প্রথম গ্র্যান্ড স্লামেই চ্যাম্পিয়ন। অবাছাই হিসেবে মেলবোর্ন পার্কে প্রায় গোড়া থেকেই কঠিন ‘ড্র’ সামলাতে হয়েছে লিয়েন্ডারদের। তা সত্ত্বেও গোটা টুর্নামেন্টে মাত্র একটা সেট হেরেছে ওরা। কোর্ট এবং কোর্টের বাইরেও কী অসম্ভব ভাল বোঝাপড়া, তালমিল থাকলে তবেই না কোনও ডাবলস টিমের পক্ষে গ্র্যান্ড স্লামে এ রকম পারফরম্যান্স দেখানো সম্ভব!
এবং এখানেই লিয়েন্ডারের কৃতিত্ব। পুরুষ ডাবলসে সাতটা গ্র্যান্ড স্লাম জিতেছে চার জন বিভিন্ন পার্টনার নিয়ে। ভারতীয় ডেভিস কাপ দলের নন-প্লেয়িং ক্যাপ্টেন হিসেবে পনেরো বছরেরও আগে আমিই প্রথম লিয়েন্ডার পেজ-মহেশ ভূপতিকে একসঙ্গে ডাবলস খেলিয়েছিলাম। তিনটে গুণ ওদের খেলায় দেখে। এক) লিয়েন্ডারের ঈশ্বর-প্রদত্ত ফিটনেস আর নেটের সামনে অবিশ্বাস্য রিফ্লেক্স। দুই) মহেশের অতুলনীয় ব্যাকহ্যান্ড রিটার্ন। তিন) ওই সময়ে দু’জনের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। একে অন্যের পরিপূরক হয়ে ওঠার ক্ষমতা। এত বছর পরে লিয়েন্ডার-স্টেপানেকের খেলার মধ্যেও যেন ঠিক ওই তিনটে ব্যাপার লক্ষ করছি। এই জুটি এ বছর আরও একটা গ্র্যান্ড স্লাম জিতলেও আমি অবাক হব না। চেকরা ওদের দেশে নিয়মিত ক্লে কোর্টে খেলে বেড়ে ওঠে বলে এবং লিয়েন্ডারের খেলাটাও ও রকম সারফেসে খুব ভাল খোলে বলে আমার মতে ফরাসি ওপেন জেতার সম্ভাবনাই বেশি ওদের জুটির। |
মেলবোর্নে টিম লিয়েন্ডার। শনিবার। ছবি: এএফপি |
টেনিসের মতো প্রচণ্ড পাওয়ার এবং পরিশ্রমসাধ্য খেলায় লিয়েন্ডারের টানা দু’দশকেরও বেশি শীর্ষে বিরাজ করা এবং ১৪ বছর ধরে গ্র্যান্ড স্লাম জিতে চলার রহস্য কী, তা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। আমার মতে রহস্য-টহস্য কিচ্ছু নয়। ওর ঈশ্বরদত্ত ফিটনেস আর রিফ্লেক্সের কথা আগেই বলেছি। যে দুটো মহাগুণকে লিয়েন্ডার বছরের পর বছর ধরে লালনপালন করে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রেখে চলেছে খুব সহজ-সরল জীবনযাপন করে। মদ ছোঁয় না। সিগারেট খায় না। বছরের প্রতিটা দিন ঘড়ি ধরে যোগাভ্যাস করে। ‘ডায়েট’-এর ব্যাপারে একেবারে নিখুঁত। এক দিনও কঠিন ট্রেনিং শিডিউল বাদ দেয় না।
টিভিতে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে দেখে থাকবেন নিশ্চয়ই যে, লিয়েন্ডার মাইকে নিজের বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রথমেই ওর সাপোর্ট স্টাফকে ধন্যবাদ দিল। তার পরে নিজের পরিবার, ভক্তদের। আর একজনকেও উড়ন্ত চুম্বন ছুড়ে ধন্যবাদ দিয়েছে অবশ্যই। সেই মহিলা রড লেভার এরিনার প্লেয়ার্স এনক্লোজারে বসেছিল। মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা। বছর দশেক আগে লিয়েন্ডার যখন ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে টেনিসই ছেড়ে দেবে ভেবেছিল, মার্টিনাই ওর ‘মোটিভেটর’ হয়ে উঠেছিল। ওদের মিক্সড ডাবলস জুটি শুধু দু’টো গ্র্যান্ড স্লামই জেতেনি, মার্টিনার ‘পেপটক’-এ বলা যায় লিয়েন্ডারের টেনিসের পুনরুজ্জীবন ঘটেছিল। আমি নিশ্চিত, এ দিন বিশ্বের এক নম্বর জুটিকে উড়িয়ে দেওয়ার সাহস ও ক্ষমতা ভিআইপি গ্যালারি থেকেও লিয়েন্ডারের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। ফাইনাল ম্যাচ চলাকালীন লিয়েন্ডার-মার্টিনার মধ্যে কয়েক বার চোখাচোখি হয়ে থাকলেও আমি অবাক হব না।
আর একজন ‘মোটিভেটর’-ও হয়তো অদৃশ্যে রয়েছে লিয়েন্ডারের সামনে এই মুহূর্তে। তাঁকে হয়তো লিয়েন্ডার মনে মনে বলছে, আমাকে ত্যাগ করে তোমার কী হল দ্যাখো! আমাদের দু’জনেরই এই একটা গ্র্যান্ড স্লাম এত দিন অধরা ছিল। তুমি নতুন পার্টনার নিয়েও সেই দুঃখ ঘোচাতে পারলে না। আমি কিন্তু পারলাম। মহেশ ভূপতি ভবিষ্যতে রোহন বোপান্নাকে নিয়ে কতটা সফল হবে সেটা পরের কথা। আপাতত এটা প্রমাণিত যে, লিয়েন্ডার একটা খুব ভাল এবং কার্যকর সঙ্গীকে নতুন মরসুমে বেছেছে। গত ১৪ বছরে তিন বার অস্ট্রেলীয় ওপেন ডাবলস ফাইনালে উঠেও শেষরক্ষা হয়নি লিয়েন্ডারের। দু’বার মহেশ এবং এক বার মার্টিন ডাম-কে নিয়ে। শনিবার লিয়েন্ডারের পুরুষ ডাবলসে ‘কেরিয়ার গ্র্যান্ড স্লাম’ হলই শুধু নয়। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে টেনিস জীবনের দ্বিতীয় ‘গ্র্যান্ড স্লাম ডাবল’ হলেও অবাক হব না। বরং সেটাই এখন স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। রবিবার এলেনা ভেসনিনাকে নিয়ে লিয়েন্ডার মিক্সড ডাবলস চ্যাম্পিয়ন হলে ১৯৯৯-এর উইম্বলডনের পর ফের একটা গ্র্যান্ড স্লামে দ্বিমুকুটের অধিকারী হবে। চোদ্দো বছরের ব্যবধানে। ভাবা যায়!
এর পরে লিয়েন্ডারকে বিশ্বের সর্বকালের সেরা দশ ডাবলস স্পেশ্যালিস্ট-এর তালিকায় রাখতে আমার কোনও দ্বিধা নেই। জন ম্যাকেনরো (৭৭টা সিঙ্গলস খেতাবের সঙ্গে ৭৭টা ডাবলস ট্রফিও জিতেছে), বব হিউইট, টনি রোচ, রাফেল ওসুনা, ফ্রেড স্টোলি, উডব্রিজ, উডফোর্ড, বব-মাইক ব্রায়ানদের সঙ্গে একাসনে থাকবে আমাদের লিয়েন্ডার। আজকের পরে লিয়েন্ডারকে সামনের অগস্টে লন্ডন অলিম্পিকে ডাবলস টিমে রাখা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই ভারতীয় টেনিস কর্তাদের।
|
লিয়েন্ডার পেজের ১৩ গ্র্যান্ড স্লাম |
পুরুষ ডাবলস (৭) |
• অস্ট্রেলীয় ওপেন |
(২০১২) |
• ফরাসি ওপেন |
(১৯৯৯, ২০০১, ০০৯) |
• উইম্বলডন |
(১৯৯৯) |
• যুক্তরাষ্ট্র ওপেন |
(২০০৬, ২০০৯) |
মিক্সড ডাবলস (৬) |
• অস্ট্রেলীয় ওপেন |
(২০০৩, ২০১০) |
• উইম্বলডন |
(১৯৯৯, ২০০৩, ২০১০) |
• যুক্তরাষ্ট্র ওপেন |
(২০০৮) |
|