সলমন রুশদি তো ২০০৭ সালেই জয়পুর সাহিত্য উৎসবে এসেছিলেন। তখন তাঁকে আটকানো হয়নি কেন? শনিবার পড়ন্ত বিকেলে বইমেলার ইউবিআই অডিটোরিয়ামে প্রশ্ন তুললেন প্রবীণ সাংবাদিক বিনোদ মেটা। তাঁর মতে, সে বার উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে কংগ্রেসের বিন্দুমাত্র আশা ছিল না। তাই রুশদিকে আসতে বাধা দেওয়া হয়নি। এ বার কিঞ্চিৎ হলেও আশা আছে। ফলে মুসলিম ভোটব্যাঙ্কের দিকে তাকিয়েই ‘নিষিদ্ধ’ রুশদি। বিনোদের কথায়, “এমনি ভাবেই সত্যকে চাপা দিতে চায় রাজনৈতিক দলগুলি। সংবাদমাধ্যম তা ফাঁস করলেই তাকে দাঁড় করানো হয় কাঠগড়ায়।
বইমেলায় কলকাতা সাহিত্য উৎসবে এ দিনের বিতর্ক অবশ্য ছিল, কেন সংবাদমাধ্যম বিচারকের ভূমিকায়, তা নিয়েই। রাজনৈতিক নেতাদের চিরাচরিত বক্তব্য, খবরের কাগজ আর খবরের চ্যানেল সব বিষয় নিয়েই বড্ড বাড়াবাড়ি করে। তারা নিজেরাই অভিযোগ করে, নিজেরাই তদন্ত করে, বিচার করে, শেষ পর্যন্ত রায়ও দিয়ে দেয়। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।
জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা বেশি ‘বিরক্ত’ দিনভর চলা খবরের চ্যানেলের উপর। তাঁর ব্যাখ্যা, “সময়ের সঙ্গে ছুটতে গিয়ে একটা খবর বুঝে ওঠার জন্য যতটা সময় দেওয়া দরকার, ততটা এই চ্যানেলগুলি দিতে পারে না। ফলে সত্য বিকৃত হয়।” ওমরকে পাল্টা বিঁধলেন ২৪ ঘণ্টার একটি খবরের চ্যানেলের প্রধান সম্পাদক রাজদীপ সরদেশাই। “বিশ বছর আগে টিভি খুললে ওমরের মতো রাজনীতিকদের শুধু ফিতে কাটার ছবিই দেখা যেত। টেলিভিশন সাংবাদিকতা পাল্টে গিয়েছে, রাজনীতিকরা পাল্টাননি।” বললেন রাজদীপ। তাঁর স্পষ্ট কথা, “শুধু বক্তৃতা দেখালে বা লিখলে রাজনীতিকরা খুশি হবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু সাংবাদিকরা স্টেনোগ্রাফার নন। তাঁদের কাজ প্রশ্ন করা। অপ্রীতিকর প্রশ্ন করা। তাতে যদি রাজনীতিকরা চটেন, কিছু করার নেই।” যার জবাবে ওমর বললেন, “প্রশ্ন করুন, তদন্ত করুন ক্ষতি নেই। কিন্তু দয়া করে বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন না।” |
সংবাদমাধ্যমের ‘বিচারক’ ভূমিকার উদাহরণ দিতে গিয়ে রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী বললেন, “নতুন রেলনীতি তৈরির কথা বলে কী বিপাকেই না পড়েছিলাম। কাগজে লিখে দিল, মমতার নীতি আমার পছন্দ হচ্ছে না। অথচ আমি বলতে চেয়েছিলাম, বিদেশনীতির মতো একটা রেলনীতি গড়া দরকার। সরকার বদলালেও যার বদল হবে না।”
এ হেন ‘খবর’ করা সংবাদমাধ্যমের দায়বদ্ধতা নিয়েই প্রশ্ন তুললেন দীনেশ। তাঁর বক্তব্য, রাজনীতিকরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ভোটারদের মুখোমুখি হতে হয় তাঁদের। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের দায় তো শুধু সার্কুলেশন এবং টিআরপি-র প্রতি। যা শুনে রে রে করে উঠলেন বিনোদ, রাজদীপ দু’জনেই। পাল্টা শুনিয়ে দিলেন, পাঠক-দর্শকদের প্রতি সংবাদমাধ্যমের প্রতিদিনের দায়বদ্ধতা। রোজ রোজ ভুল খবর দিয়ে কেউই টিকে থাকতে পারে না।
এ দেশে সংবাদমাধ্যমের তৎপরতার সব চেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে রয়েছে জেসিকা লাল হত্যা মামলা। ১৯৯৯-এর এপ্রিলে দিল্লির একটি পার্টিতে খুন হন জেসিকা। প্রধান অভিযুক্ত, হরিয়ানার প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতার ছেলে মনু শর্মা বেকসুর খালাস হয়ে গিয়েছিলেন নিম্ন আদালতে। তার পরেই শোরগোল ওঠে সংবাদমাধ্যমে। চলে লাগাতার প্রচার। যার জেরে একটানা ২৫ দিন শুনানি চালিয়ে রায় ঘোষণা করে দিল্লি হাইকোর্ট। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় মনুর। সুপ্রিম কোর্টেও বহাল থাকে সেই সাজা। এ দিনের বিতর্কসভায় স্বাভাবিক ভাবেই উঠল সেই প্রসঙ্গ। উঠল নীতীশ কাটারার কথাও। এ ক্ষেত্রেও তো প্রভাবশালী রাজনীতিকের বিরুদ্ধে ‘লড়াই’ করেছিল সংবাদমাধ্যম। যে লড়াইকে গণতন্ত্রের পক্ষে স্বাস্থ্যকর বলেই মনে করছেন বিনোদ মেটা। তাঁর কথায়, “সংবাদমাধ্যম যদি রাজনীতিকদের সুরে সুর মেলাতে শুরু করে, তা হলে গণতন্ত্র বলে কিছু থাকে না। যেমন নেই চিন, উত্তর কোরিয়া, কিউবায়।”
কিন্তু সাংবাদিকেরা কি কখনও কখনও লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করে যান না? এমন কিছু বলে বসেন না, যা তাঁদের বলা উচিত নয়? তেমনটা যে ঘটে, মেনে নিচ্ছেন বিনোদ, রাজদীপ দু’জনেই। কিন্তু একই সঙ্গে সাফাই দিলেন এই বলে যে, এ দেশে রাজনৈতিক কাঠামো এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম না করে উপায় নেই। সেই অবক্ষয়ের কথা কবুলও করে নিলেন বিতর্কসভায় উপস্থিত দুই রাজনীতিক ওমর আবদুল্লা এবং দীনেশ ত্রিবেদী। ওমর বললেন, “রাজদীপের বিশ্বাসযোগ্যতা আমার থেকে বেশি। ফলে ও ঠিক কথা বলছে বলেই লোকে মেনে নেয়।” আর দীনেশ বললেন, “দয়া করে আমি যা বলিনি, তা লিখবেন না। নইলে দলীয় নেতৃত্বকে বোঝাতে যে কী কালঘাম ছোটাতে হয়, তা আমরাই জানি!” |