গল্প-ইতিহাসের মোহনায় বাংলাকে ছুঁলেন ম্যানফ্রেডি
তিহাসের সঙ্গে সাহিত্যের তফাত কোথায়? শনিবার বিকেলে বইমেলার ‘অশোককুমার সরকার স্মারক বক্তৃতা’য় সেটি পরিষ্কার করে দিলেন ইতালির লেখক ভ্যালেরিও মাসিমো ম্যানফ্রেডি, “ইতিহাসের একটা দায় থাকে। আদালতে দাঁড়িয়ে সত্য প্রমাণ করতে হয় তাকে। গল্পের সেই দায় নেই। কিন্তু সে আমাদের আবেগে ধাক্কা মারে। কেন না, জীবনের থেকে আমাদের মন অনেক বড়। ফলে সে আরও কিছু জীবনের কথা, বিকল্পের কথা জানতে চায়।”
ইতিহাসের ‘সত্য’ আর পুরাকথা, গল্পের ‘আবেগ’কে একসঙ্গে মিশিয়ে দেওয়াতেই তাঁর কৃতিত্ব। ওই ঘরানাতেই তাঁর কলম থেকে বেরিয়েছে ‘আলেকজান্দার’, ‘ফারাও’, ‘হিরোজ’-এর মতো বেস্টসেলার উপন্যাস। রোম সাম্রাজ্যের শেষ লড়াই নিয়ে তাঁর উপন্যাস ‘দ্য লাস্ট লিজিয়ন’-ও হলিউডের পর্দায় সাড়া জাগিয়েছিল। বেন কিংসলে থেকে কলিন ফার্থ, মায় ভারতের ঐশ্বর্যা রাই কে না ছিলেন সেই ছবিতে?
অশোককুমার সরকার স্মারক বক্তৃতায় ইতালীয় লেখক
ভ্যালেরিও মাসিমো ম্যানফ্রেডি। অশোক মজুমদারের তোলা ছবি।
সিনেমায় ঐশ্বর্যা ছিলেন পূর্ব রোমের এজেন্ট। তাঁর নাম মীরা। আদতে কেরলের বাসিন্দা মীরা ‘কালারিপাত্তু’ মার্শাল আর্টে তুখোড়। উপন্যাসে চরিত্রটি রোমান, নাম ছিল লিভিয়া। চিত্রনাট্যকারেরা তাকে ভারতীয় বানিয়ে দিয়েছিলেন। “তাতে আমার কোনও আপত্তি ছিল না। দেখি, ভারত নিয়ে যদি কখনও লিখি,” বক্তৃতার আগে একান্ত আলাপচারিতায় বললেন ম্যানফ্রেডি। দু’বছর আগে টিভি-সিরিজের শুটিং করতে তাজমহল, ওরছা ঘুরে গিয়েছেন। কলকাতায় এই প্রথম! আজ, রবিবার শহরে চক্কর কাটবেন তিনি। সোমবার চেন্নাই। সেখান থেকে দিল্লি হয়ে ঘরে ফেরা।
আরও কত কথাই যে বলছিলেন তিনি! “ইতিহাসকে আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। এই ঘরে, এই মুহূর্তেও এত দর্শক, প্রত্যেকের আলাদা স্মৃতি, আলাদা সত্তা, আলাদা ইতিহাস,” বললেন তিনি। শুনতে শুনতে মনে পড়ে গেল ম্যানফ্রেডির ‘আলেকজান্দার’ ট্রিলজির শুরু। ম্যাসিডোনিয়ার রাজা ফিলিপের স্ত্রী অলিম্পিয়া বিছানায় শুয়ে স্বপ্ন দেখছেন, প্রাসাদে তাঁর শয়নঘরের সামনে একটি সাপ। সেই সাপ উঠে আসে বিছানায়, গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ফেলে রানিকে। রাজা তখন গভীর ঘুমে। কয়েক দিন পরে রানি গভীর অরণ্যে এক মন্দিরে যান। পূজারীরা বলেন, ‘তোমার গর্ভে দেবতাদের রাজা জিউসের সন্তান। কম দিন বাঁচবে, কিন্তু মহাবীর হবে।’ ইতিহাসের ফিলিপ, অলিম্পিয়ার সঙ্গে গ্রিক পুরাকথার জিউস, দৈববাণী, ফ্রয়েডীয় যৌনতা সব এই ভাবেই মিলিয়ে দেন ম্যানফ্রেডি।
ম্যানফ্রেডি শুধু লেখক নন, পুরাতত্ত্ববিদ এবং ‘অ্যাডভেঞ্চারিস্ট’। ইজরায়েলের মরুভূমিতে এক বার ‘হার হারকেম’ পাহাড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালাতে গিয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, ওটিই ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’-এর সিনাই পর্বত। অভিযান চালিয়েছেন কেনিয়ার জঙ্গলেও। “সিসিলিতে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে ভূমিকম্পে একটা মন্দির ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। দেশে ফিরে সেই ধ্বংসাবশেষ অনুসন্ধানের কাজটা শেষ করতে হবে,” সাক্ষাৎকারে বলছিলেন তিনি। ঘরে-বাইরের পুরাতাত্ত্বিক অ্যাডভেঞ্চারে সমান তালে দৃষ্টি চলে বলেই বক্তৃতার শেষে বলছিলেন, “এখানে সন্ধ্যা, দুনিয়ার অন্য কোথাও এখন সকাল হচ্ছে। ২৪ ঘণ্টার বিচিত্র সব মুহূর্তই ইতিহাসের অঙ্গীভূত।”
ইতিহাস এবং ঘটনা যে কী ভাবে মিশে গেল তাঁর বক্তৃতায়! ষাটের দশকের এক ব্রিটিশ ইতিহাসবিদের কাহিনি শোনাচ্ছিলেন লেখক। আথেন্সে বেড়াতে গিয়ে ওই ইতিহাসবিদ এক কাফেতে গিয়েছেন, শ্বেতপাথরের টেবিল। হাত বুলিয়ে বুঝলেন, নীচটা এবড়োখেবড়ো। রয়েছে কি কোনও শিলালিপি?
আথেন্সের জাদুঘরে এখনও আছে সেই টেবিল। তাতে ৪৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এক নির্দেশ, পারস্যের কাছে যুদ্ধে হারের কারণে আথেনীয়দের এখনই শহর ছেড়ে চলে যেতে বলা হচ্ছে। ওই শিলালিপিটি পাওয়ার কারণেই তো বদলে গেল আথেন্স ও পারস্যের যুদ্ধ নিয়ে ইতিহাসের চলতি ধারণা!
সরস্বতী পুজোর বিকেলে ইতালীয় লেখকের বক্তৃতা তাই নিরুচ্চারে বাঙালি জীবনের একটি খেই ধরিয়ে দিল। মানসিংহ ইতিহাসের চরিত্র হতে পারেন, কিন্তু আমাদের আবেগে তো ধাক্কা দেন তাঁর পুত্র বন্দি জগৎসিংহ! বঙ্কিমের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসে যাকে নির্দেশ করে কাল্পনিক চরিত্র আয়েষা বলে, ‘বন্দি আমার প্রাণেশ্বর’। কাল্পনিক, কিন্তু আবেগময় সত্য! গল্প এবং ইতিহাসকে একসঙ্গে মিশিয়ে বঙ্কিম থেকে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের যে ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’, তাকেই যেন এ দিন ছুঁয়ে গেলেন ইতালির ম্যানফ্রেডি।
পুনশ্চ: ম্যানফ্রেডির বক্তৃতা কলকাতা সাহিত্য উৎসবের অঙ্গ। কিন্তু ২০০ আসনের প্যাভিলিয়ন নয়, এই বক্তৃতা ছিল ৭০০ আসনের ইউবিআই অডিটোরিয়ামে। প্রতি বার সেখানেই হয়। দর্শকদের সুবিধার্থে চেতন ভগত, ইমরান খানের অধিবেশনও হবে এই অডিটোরিয়ামেই। রেজিস্ট্রেশন কার্ড না থাকার কারণে, গত কালও সাহিত্য উৎসবের দরজা থেকে ফিরে গিয়েছিলেন ছাত্রছাত্রীরা। বড় অডিটোরিয়ামে সে রকম ঘটেনি! অশোককুমার সরকার স্মারক বক্তৃতাই কলকাতার প্রথম সাহিত্য উৎসবে খুলে দিল সকলের প্রবেশাধিকারের গণতান্ত্রিক পরিসর!
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.