দাঁড়কাক, রাইটিং ডেস্ক ও ল্যুইস ক্যারল
নিশ শতকের ষাটের দশক। রানি ভিক্টোরিয়ার ইংল্যান্ড তখন শনশন ছোটাচ্ছে রেলগাড়ি আর কলকারখানার গমগম শব্দে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পৃথিবী জোড়া রাজত্ব। কাঁটা-কম্পাস-দ্রাঘিমারেখা-অক্ষরেখায় নিখুঁত ছকে ফেলছে অজানা দেশের মানচিত্র। যখন নখদর্পণে অস্ট্রেলিয়া থেকে আফ্রিকা, ভারত থেকে মালয়ের ভূগোল, ঠিক তখনই একটা ভুঁইফোড় ছোট্ট বই তাক লাগিয়ে দেয় সকলকে বাংলায় এক্কেবারে এক নতুন দেশের ম্যাপ। প্রযুক্তির পাখনায় উড়ান দেওয়া দেশটা এমন আশ্চর্য সুড়ঙ্গপথের হদিশ পায়নি কখনও। এমন একটা অপূর্ব স্বপ্ন কি ইংল্যান্ডই দেখেছে কোনও দিন? আরও কিনা এই অত্যাশ্চর্য পাতালরাজ্যটা সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পারে নয় আছে ইংরেজের নিজের বাগানের মধ্যেই! কটেজের শেষ প্রান্তে ঝোপঝাড়ের ভেতর ওই মামুলি খরগোশ গর্তটার তলায়! এই উলটো নিয়মের আবোলতাবোল হিজিবিজির দেশটা প্যান্ডোরার বাক্স খুলে চিমনি ধোঁয়া ছাওয়া ইংল্যান্ডের কেজো হাওয়ায় উড়িয়ে দিলেন যে ম্যাজিশিয়ান, তাঁর নাম ল্যুইস ক্যারল। নতুন রাজ্যের পথ চেনানো লাল মলাটের বইটার নাম আজ ছোট বড় সবার জানা: ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’। প্রথম প্রকাশ ১৮৬৫-র জুলাইয়ে।
অবশ্য আসল গল্পের শুরু তার বছর কয়েক আগে। সেটাও ছিল জুলাই মাসের এক ঝলমলে রোদ্দুর মোড়া সোনালি সকাল। সে দিন অক্সফোর্ডের ক্রাইস্ট চার্চ কলেজের ডিন-এর তিন মেয়ে লোরিনা, অ্যালিস আর এডিথ লিড্ল অনুমতি পায় তাদের প্রিয় খেলার সঙ্গী, তাদের গল্প বলার বন্ধু ক্রাইস্ট চার্চ কলেজেরই প্রফেসর চার্লস লুডউইগ ডজসনের সঙ্গে পিকনিক যাওয়ার। কলেজের ছাত্রদের অঙ্ক আর লজিকের মতো শক্ত বিষয় পড়ানো মাস্টারমশাই ডজসনের ভাল লাগা, ভালবাসার জগৎটা ছিল একদম আলাদা। তাঁর ভাললাগা ছোটদের ঘিরে, ভালবাসেন তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে, তাদের জন্য মজার ছড়া, গল্প বানাতে আর, অসাধারণ দক্ষতায় তাদের সুন্দর মুহূর্তগুলো তাঁর ক্যামেরার লেন্সে ধরে রাখতে। তাই যখন আইসিস নদীর ওপর দিয়ে তাদের নৌকো চলে তরতরিয়ে, তখন অন্য দিনের মতো, ছোট্ট সঙ্গীদের আবদার রাখতে ডজসন বুনতে থাকেন গল্পের জাল। বানিয়ে বলা সে গল্পে ছদ্মবেশে মজুত পিকনিক পার্টির সবাই। আছে লোরিনা, এডিথ, ডজসনের সহকর্মী বন্ধু রবিনসন ডাকওয়র্থ এবং তিনি নিজেও। তবে সবার চেয়ে বেশি, গল্পের পুরোটা জুড়ে যে মধ্যমণি হয়ে আছে, সে হল ডিন লিড্ল-এর মধ্যম কন্যা, ডজসন-এর সব চেয়ে প্রিয় শিশু বন্ধু অ্যালিস প্লিজ্যান্স লিড্ল। দশ বছরের অ্যালিসের বড্ড পছন্দ হয় তাকে নিয়ে বানানো ওই মজার গল্প। প্রিয় ‘মিস্টার ডজসন’-এর কাছে বায়না, তাকে ওই পুরো গল্পটা লিখে দিতে হবেই হবে। ছোট্ট অ্যালিসের অনুরোধে চার্লস একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে লিখে ফেলেন সে দিনের আদ্যোপান্ত বানিয়ে বলা কাহিনি। পাতায় পাতায় জুড়ে দেন নিজের হাতে আঁকা পেন অ্যান্ড ইঙ্ক ছবিও। আর সব শেষে সেঁটে দেন তাঁরই তোলা অ্যালিসের একটা ফোটো। ১৮৬৪-র নভেম্বরে অ্যালিস মিস্টার ডজসনের থেকে ক্রিসমাসের আগাম উপহার হিসাবে পায় সবুজ চামড়ায় বাঁধানো, ছবিতে ভরা, হাতে লেখা এই আশ্চর্য সুন্দর বই: ‘অ্যালিসেস অ্যাডভেঞ্চারস আন্ডার গ্রাউন্ড’। ভেতরের পাতায় ডজসন লিখেছেন: “আ ক্রিসমাস গিফ্ট টু আ ডিয়ার চাইল্ড ইন মেমরি অব আ সামার ডে”।
বই হয়ে বেরোনোর সময় এই পাণ্ডুলিপির গল্পটাতে অল্পবিস্তর অদলবদল করেন ডজসন। ‘পাঞ্চ’-এর বিখ্যাত কার্টুনিস্ট-ইলাস্ট্রেটর জন টেনিয়েল’কে অলঙ্করণের জন্য মনোনীত করেন। ‘অ্যালিসেস অ্যাডভেঞ্চারস আন্ডার গ্রাউন্ড’-এর বদলে বইয়ের নাম হয় “অ্যালিসেস অ্যাডভেঞ্চারস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড”। লেখকের নাম: “ল্যুইস ক্যারল”। যদিও পিকনিকে গল্পটা বলেছিলেন ‘মি. ডজসন’, তাঁর প্রথম প্রকাশিত ছোটদের বইয়ের জন্য ডজসন বেছে নেন তাঁর আগের এই ছদ্মনাম। লন্ডনের নামকরা পাবলিশিং হাউস ম্যাকমিলান অবশেষে প্রকাশ করে বইটি। ১৮৬৫-র প্রথম সংস্করণ থেকে আজ পর্যন্ত ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ বেস্টসেলার এক বারের জন্যও আউট অব প্রিন্ট হয়নি। ১৮৯৮-এ মারা গিয়েছেন চার্লস লুডউইগ ডজসন। কিন্তু এখনও অমর লুইস ক্যারল।
টিম বার্টন পরিচালিত ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ (২০১০) চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য।
অ্যালিস-এ নতুন ছিল অনেক কিছুই। এমন ননসেন্সের ফোয়ারা ছেটানো, হাসির খই ফোটানো, আলো ঝলমলে, ফুরফুরে বাতাস ভরা ছোটদের বই ইংরেজি সাহিত্যে আগে তেমনটা ছিল কই? ক্যারল-এর গল্পে নেই নীতিবাক্যের ঘেরাটোপ, নেই ছোটদের ভয় পাওয়ানো শাস্তির জুজু। কে জানত এ রকম লুকানো দরজা পিছলে গলে যাওয়া যায় আর এক জগতে! আলমারির ভেতর দিয়ে নার্নিয়ার রাস্তা বা হ্যারি পটার সিরিজের আপাত-অদৃশ্য 9 3/4 নম্বর প্ল্যাটফর্মের গোড়াপত্তন অ্যালিস-এর খরগোশ গর্তের মধ্যেই। তবে বোধ হয় ম্যাথেমেটিশিয়ান ডজসনের নির্ভুল ছবি তোলার চোখ ও তাঁর শিশুসঙ্গপ্রিয় মনের দৌলতে, সব কিছু ছাপিয়ে ভীষণ নতুন, ভীষণ জীবন্ত হয়ে ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’-এ ফুটে উঠেছিল ভিক্টোরিয়ান শৈশব। দশ বছরের অ্যালিস লিড্ল-এর জ্বলজ্বলে ছবি। ক্যারলের গল্পের অ্যালিস রূপকথার ‘ভাল মেয়ে’ সিনড্রেলা বা নেকড়ের খপ্পরে পড়া সরল রেড রাইডিং হুড নয় মোটেই। এমনকী ডিকেন্সের জনপ্রিয় গল্পের ‘লিটল নেল’ বা ‘অলিভার টুইস্ট’ও ফিকে হয়ে যায় তার পাশে। এ যেন একেবারে ছবি থেকে বেরিয়ে আসা ফুটফুটে, ছটফটে, মিষ্টি, দুষ্টু, উৎসুক, কৌতূহলী সত্যিকারের একটা শিশু। তার ওয়ান্ডারল্যান্ড-এ যাওয়ার মজাই আলাদা। সেখানে শাসনের বালাই নেই। বরং স্কুলে শেখা নীতি-উপদেশগুলো কেমন সব তালগোল পাকিয়ে যায় পাতাল রাজ্যের উদ্ভট নিয়মে। সেখানে ইচ্ছে মতো হওয়া যায় ছোট থেকে বড়, বা বড় থেকে ছোট। ওয়ান্ডারল্যান্ড-এর সময় চলে নিজের মতো। চায়ের আসরে ঘড়ির কাঁটা আটকে থাকে ছ’টায়। সেখানে না মেলে অঙ্কের উত্তর, না হয় ধাঁধার সমাধান। অ্যালিসকে জব্দ করার জন্য ম্যাড হ্যাটার যখন জিজ্ঞাসা করে ‘বলো তো হে, দাঁড়কাক আর রাইটিং ডেস্ক-এর মিল কোথায়?’ তখন অ্যালিস দারুণ উৎসাহে মাথা খাটিয়ে খুঁজতে থাকে ঠিক উত্তরটা। বেশ খানিক ক্ষণ হন্যে হয়ে ভাবার পর, উত্তর না পেয়ে অগত্যা ফের ম্যাড হ্যাটারকেই জিগ্যেস করতে হয় ঠিক উত্তরটা কী! অ্যালিস-এর যাবতীয় উৎসাহ, প্রত্যাশার ওপর এক বালতি জল ঢেলে দিয়ে মুখে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে হ্যাটার জানায়, ‘I haven’t the slightest idea’. অ্যালিসের মতো পাঠকও ওয়ান্ডারল্যান্ড-এ পদে পদে অপদস্থ, লাইনে লাইনে চমৎকৃত। সর্ব ক্ষণ মনে হয়, আরে, এমনটা আবার হয় নাকি!
যদিও বিশ্বের দরবারে অ্যালিস থেকে শুরু ক্যারল-এর পরিচিতি, এই বইয়ের আগে ও পরে গণিতের অধ্যাপক ডজসন লিখেছেন বহু বিষয়ে, নানা genre-এ। লিখেছেন লজিক-এর বই ‘দ্য ম্যাথেমেটিক্যাল প্যামফ্লেট্স’। আবার তিনিই লিখেছেন ভোট-বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে শুরু করে নতুন ধরনের লন টেনিস খেলার নিয়মকানুন। গবেষকদের ধারণা, তাঁর লেখা চিঠির সংখ্যা এক লক্ষ তিন হাজার সাতশো একুশেরও বেশি। এ ছাড়াও ডজসন বিখ্যাত হতে পারতেন শুধুমাত্র তাঁর শখের ফোটোগ্রাফির জন্য। তিনি যে ভাবে ছবির পর ছবিতে ক্যামেরাবন্দি করেছেন তাঁর সময়ের শৈশবকে তা নজিরবিহীন। চার্লস-এর লেখালিখি শুরু ছেলেবেলা থেকে। স্কুলে পড়ার সময় বানাতেন ক্লাসে শেখা কবিতার প্যারডি।
‘অ্যালিসেস অ্যাডভেঞ্চারস আন্ডার গ্রাউন্ড’ বইটির মূল খসড়ার একটি পাতা।
ভাই-বোনদের সঙ্গে মিলে বার করতেন হাতে লেখা একাধিক পারিবারিক পত্রিকা। সবেতেই উঁকি দেয় ননসেন্স চিন্তা, শব্দের জাদুকরী, প্যারডি-র প্রবণতা। তখন থেকেই তাঁর অবস্থান মর্যাল ভারাক্রান্ত ভিক্টোরিয়ান শিশু-সাহিত্য থেকে শতহস্ত দূরে। চোদ্দো বছরের চার্লস-এর মনে হয় ছোটদের সব সময় সব কিছুতেই বলা হচ্ছে, ‘you mustn’t’. তাই তাঁর নিজের সৃষ্টির ওয়ান্ডারল্যান্ড ও সবের ধার ধারে না। ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’-এর পরে ক্যারল লিখেছেন, ‘থ্রু দ্য লুকিং গ্লাস’, ‘দ্য হান্টিং অব দ্য স্নার্ক’ ও ‘সিলভি অ্যান্ড ব্রুনো’র মতো বই। তৈরি করেছেন বহু মজার খেলা, নানা ধরনের রিডল, পাজল আর ব্রেন টিজার। তবে সবচেয়ে বড় ধাঁধাটা রেখে গিয়েছেন নিজের জীবনে।
ডজসন-এর মৃত্যু থেকে আজ অবধি তাঁকে আর তাঁর অ্যালিস বইগুলোকে নিয়ে বিস্তর কাটাছেঁড়া হয়েছে। তাঁর জীবনকে, তাঁর মনকে, তাঁর লেখাকে, এমনকী, সত্যিকারের অ্যালিসকেও চুলচেরা বিশ্লেষণে বিভিন্ন ভাবে তুলে ধরেছেন গবেষক ও জীবনীকারেরা। প্রশ্ন উঠেছে কোনটা আসল, কোনটা ছদ্মবেশ? সাদামাটা লাজুক অঙ্কের মাস্টারমশাই, আজীবন অবিবাহিত রেভারেন্ড চার্লস লুডউইগ ডজসন, নাকি রঙিন, ফ্ল্যামবয়েন্ট, অসামান্য প্রতিভার লুইস ক্যারল? ধোঁয়াশা রয়েছে অ্যালিস স্রষ্টার ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষেত্রেও ডজসন-এর ডায়েরির ছেঁড়া পাতার রহস্য বা লিডল পরিবারের সঙ্গে তাঁর চিড় ধরা সম্পর্কের মিসিং লিঙ্কগুলো আজও অস্পষ্ট। কারও চোখে তিনি রোম্যান্টিক শৈশব-প্রেমী, কোনও জীবনীকারের মতে, তাঁর লেখায় ও ফোটোগ্রাফিতে প্রচ্ছন্ন পেডোফিলিক মানসিকতা। কেউ মনে করেন, তিনি ছিলেন অ্যালিস লিডল-এর পাণিপ্রার্থী, আবার কারও ধারণায় তিনি প্রেমে পড়েছিলেন অ্যালিসের মা মিসেস লোরিনা লিডল-এর। তবে কি তিনি জেকিল অ্যান্ড হাইড সিনড্রোম-এ দিনের বেলায় ভিক্টোরিয়ান সমাজের ছকে বাঁধা অক্সফোর্ড ডন আর রাতের আঁধারে ছাতার পাখায় উড়ে যাওয়া ফ্যান্টাসি-বিলাসী? তাঁর জীবনের ‘সত্যি’ বনাম ‘ফিকশন’-এর ধাঁধার সমাধান আজও হয়নি। আর্গুমেন্ট, কাউন্টার-আর্গুমেন্ট, এভিডেন্স, কাউন্টার-এভিডেন্স-এর উত্তপ্ত চাপান-উতোরের মাঝে কোথাও যেন অদৃশ্য ক্যারল ক্রাইস্ট চার্চ-এর মাঠে বসে মুচকি হাসেন। ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘ও হে বাপু, মেলা গোল কোরো না। ও উত্তরটা আমারও জানা নেই।’



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.