আমরি-কাণ্ডের দেড় মাস পরে ওই হাসপাতালের পরিচালন বোর্ডের দুই চিকিৎসক-সদস্যকে শুক্রবার গ্রেফতার করল কলকাতা পুলিশ। ধৃতদের এক জন আমরি’র ম্যানেজিং ডিরেক্টর ৯৩ বছরের মণি ছেত্রী। অন্য জন স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক প্রণব দাশগুপ্ত। তাঁদের জামিনের আর্জিও এ দিন খারিজ হয়ে গিয়েছে। দুই চিকিৎসককে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে আলিপুর আদালত। ধৃত মণিবাবু রাতে বুকে ব্যথা অনুভব করায় তাঁকে এসএসকেএমে নিয়ে গিয়ে আইসিইউয়ে ভর্তি করা হয়।
গত ৮ ডিসেম্বর রাতে ঢাকুরিয়া আমরি-তে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হাসপাতালের পরিচালন বোর্ডের মোট ১৫ সদস্যের মধ্যে এই নিয়ে ন’জনকে গ্রেফতার করল পুলিশ। বাকিদের মধ্যে তিন ডিরেক্টর (আদিত্যবর্ধন অগ্রবাল, রাহুল তোদি, প্রীতি সুরেখা) পলাতক, তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। অন্য তিনটি পদ সরকারি প্রতিনিধির। তার দু’টি অবশ্য খালি। আমরির’র পরিচালন বোর্ডে রাজ্য সরকারের যে এক মাত্র প্রতিনিধি এখন রয়েছেন, ৩১ জানুয়ারি তাঁর অবসর নেওয়ার কথা। তাঁর বিরুদ্ধে অবশ্য কোনও অভিযোগ এখনও পুলিশ তোলেনি।
কেন তোলেনি, তা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। একই ভাবে প্রশ্ন উঠেছিল, মণিবাবু-প্রণববাবুকে বার বার লালবাজারে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ এত দিন কেন কোনও অভিযোগ আনেনি। পুলিশের ‘নিরপেক্ষতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল বণিকসভা ফিকি-ও। এ দিন ওঁরা গ্রেফতার হওয়ার পরেও ব্যবসায়ী মহলের একাংশে কলকাতা পুলিশের ভূমিকা পরিষ্কার নয়। এক বণিকসভার এক কর্তার কথায়, “আমরি’র ঘটনার দিনই অন্যতম ডিরেক্টর প্রণব দাশগুপ্ত দেশের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু আদিত্যবর্ধন-রাহুল-প্রীতির মতো তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ দায়ের করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেনি পুলিশ। দেশে ফেরার পরে ওঁকে একাধিক বার লালবাজারে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্তকারীরা। মণিবাবুকেও তা-ই। অথচ ওঁঁদের গ্রেফতার করা হল দেড় মাস পরে!”
অন্য দিকে প্রবীণ চিকিৎসক মণি ছেত্রীকে গ্রেফতারের ব্যাপারে রাজ্য সরকারের ভূমিকা নিয়ে এ দিন আদালতে অভিযোগ তুলেছেন তাঁর আইনজীবীরা। তাঁদের দাবি, জনমানসে ‘প্রভাব বিস্তার’ করতেই মণিবাবুর মতো নামী চিকিৎসককে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। আলিপুর আদালতে বিচারক চৌধুরী হেফাজত করিমের এজলাসে মণিবাবুর আইনজীবী ভাস্কর সেন বলেন, তাঁর মক্কেলের বয়স ৯৩। রক্তচাপ ও হার্টের সমস্যায় ভুগছেন, হাঁটাচলা করতেও সাহায্যকারী লাগে। ভাস্করবাবুর দাবি: হাসপাতালের এমডি হলেও তিনি শুধু চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখতেন। সুরক্ষা সম্পর্কে তাঁর কিছু জানার কথা নয়। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি তাঁর মক্কেলকে জামিন মঞ্জুরের আর্জি জানান। মণিবাবুর অন্য আইনজীবী এস কে কপূরের অভিযোগ, পুলিশ তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে অভিযোগের যথার্থতা প্রমাণ করতে তো পারেইনি, এমনকী গ্রেফতারির কারণও জানাতে পারেনি। |
মণিবাবুর হয়ে সওয়াল করতে এ দিন আদালতে হাজির ছিলেন আইনজীবী সমরাদিত্য পালও। প্রণববাবুর আইনজীবীরা আদালতকে বলেন, তাঁদের মক্কেল নামী চিকিৎসক, ইস্টবেঙ্গল ক্লাব, বেঙ্গল ক্লাবের সভাপতি। তিনি তদন্তে পুলিশকে সাহায্য করেন। ওঁদের মতে, ভিত্তিহীন অভিযোগে এবং উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া প্রণববাবুকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
পাল্টা সওয়ালে সরকারি আইনজীবীরা জামিনের বিরোধিতা করে দাবি করেন, হাসপাতাল পরিচালনা সংক্রান্ত এমন অনেক তথ্য ধৃতদের কাছে রয়েছে, যেগুলো তদন্তকারীদের হাতে আসা জরুরি। তাঁদের হেফাজতে পেলে তথ্য সংগ্রহে পুলিশের সুবিধা হবে। সরকারপক্ষের কৌঁসুলি দেবাশিস রায় ও শক্তি ভট্টাচার্য বলেন, মণি ছেত্রী যে হাসপাতালের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, সেখানে সুরক্ষা-ব্যবস্থার গাফিলতিতে অনেক রোগী মারা গিয়েছেন। কর্মীরা সুরক্ষা নিয়ে বার বার সাবধান করলেও কর্তারা শোনেননি। আর মণিবাবুর ‘শারীরিক অসুস্থতা’র তত্ত্ব খারিজ করে ওঁদের বক্তব্য: ওই চিকিৎসক রোজ ছ’টা নার্সিংহোমে যান। কিন্তু ঘটনার দিন তিনি কেন আমরি যাননি, তার ব্যাখ্যা মণিবাবু দিতে পারেননি বলে সরকারি আইনজীবীদের দাবি।
দু’পক্ষের সওয়াল শোনার পরে বিচারক দুই চিকিৎসকের জামিনের আবেদন খারিজ করে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দেন। পুলিশ কী বলছে?
লালবাজার সূত্রের বক্তব্য: মণিবাবু গোড়া থেকেই আমরি’র ম্যানেজিং ডিরেক্টর। হাসপাতালের লাইসেন্সও তাঁর নামে। তাই তিনি অগ্নিকাণ্ডের দায় এড়াতে পারেন না। আর হাসপাতালের প্রশাসনিক বিষয় সংক্রান্ত যে কোনও সিদ্ধান্ত প্রণববাবুর সই ছাড়া নেওয়া যেত না। তাই ওই দুই ডিরেক্টরকে গ্রেফতার করা জরুরি হয়ে পড়েছিল।
তবে প্রশাসনিক মহলের একাংশের ব্যাখ্যা: আমরি-কাণ্ডে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে যে ‘বার্তা’ যাচ্ছিল, বোর্ডের দুই চিকিৎসক-সদস্যকে গ্রেফতারের পরে সেই প্রচারের মোকাবিলা করা যাবে। উল্লেখ্য, বণিকসভা ফিকি’র বক্তব্য ছিল, হাসপাতাল পরিচালনার দৈনন্দিন কাজে যাঁরা যুক্ত নন, তাঁদের আটক রাখা হলে ‘ভুল বার্তা’ যায়। ‘রাজস্থান-বেঙ্গল মৈত্রী পরিষদ’-এর তরফেও বলা হয়েছিল, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় রাজস্থান ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যে দীর্ঘ কালের ‘সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্কে’ চিড় ধরার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্য দফতরের এক সূত্রের ধারণা, পুলিশের ‘নিরপেক্ষতা’ সম্পর্কে এই সব বক্তব্যে রাজ্য সরকারের উপরে চাপ বাড়ছিল। মণিবাবু-প্রণববাবুর গ্রেফতারির পরে শুধু একটি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই ব্যবস্থাগ্রহণের কথা বলার জায়গা আপাতত থাকছে না বলে মনে করছে প্রশাসনের একাংশ। |
প্রশ্ন যদিও থেকে যাচ্ছে। কী রকম?
আমরি’র পরিচালন বোর্ডের সরকারি প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ কেন এখনও আনা হল না, আমরি-কর্তাদের আইনজীবীরা সেই প্রশ্ন তুলেছেন। উল্লেখ্য, আমরি’র পরিচালন বোর্ডের তিন সরকারি প্রতিনিধির মধ্যে এক জন রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা। অন্য দু’জন আইএএস। এই মুহূর্তে আইএএস সুকুমার ভট্টাচার্য ছাড়া বোর্ডে আর কোনও সরকারি প্রতিনিধি নেই। কারণ, নতুন স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার নাম যেমন বোর্ডে ঢোকানো হয়নি, তেমন অন্য আইএএস অসীম দাসের অবসরের পরে তাঁর জায়গায় নতুন লোক পাঠায়নি সরকার। কেন? |
স্বাস্থ্য দফতরের দাবি: আমরি’র দৈনন্দিন কাজকর্মে তাঁদের প্রতিনিধিদের কোনও ভূমিকা ছিল না। তাই ওঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার যুক্তিই থাকতে পারে না। এক স্বাস্থ্য-কর্তার মন্তব্য, “আমরি হাসপাতালে রাজ্যের শেয়ার কমতে কমতে এখন ১.৯%। বোর্ডের বৈঠকে ইদানীং সরকারি প্রতিনিধিদের ডাকাই হত না। তাই ফাঁকা দুই পদে নতুন কাউকে পাঠানো হয়নি। আর যে আইএএস অফিসার এখন রয়েছেন, তিনি আগামী সপ্তাহেই অবসর নেবেন।” কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা-প্রধান দময়ন্তী সেন বলেন, “এই ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে কে, কী ভাবে, কতটা জড়িত, অথবা আদৌ জড়িত কি না, তদন্তের স্বার্থে সবই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তদন্ত এখনও শেষ হয়নি।’’ পুলিশ-সূত্রের খবর: আমরির পরিচালন বোর্ডে রাজ্য সরকারি প্রতিনিধিদের এই মামলায় সাক্ষী হিসেবে ব্যবহার করতে পারে কলকাতা পুলিশ।
মণিবাবু-প্রণববাবুর গ্রেফতারের পরে আমরি-কাণ্ডে ধৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৩। হাসপাতালের ভাইস প্রেসিডেন্ট পৃথা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নাইট ইনচার্জ সাজিদ হোসেনকে সোমবার গ্রেফতার করা হয়েছে। তার আগে ধরা পড়েছেন আর এক ভাইস প্রেসিডেন্ট সত্যব্রত উপাধ্যায় ও জেনারেল ম্যানেজার (মেনটেন্যান্স) সঞ্জীব পাল।
|