দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা কোনও দিন সে অর্থে আলোকবৃত্তে আসেননি।
অথচ, তাঁরা গোটা জীবন ধরে জেলার মনন এবং সাংস্কৃতিক মানচিত্রকে রঙিন করে
তুলেছেন। মাটি থেকে উঠে আসা সেই সব মানুষের কথা। |
নবদ্বীপের বাদরাপাড়ায় দশ বাই পনেরোর ঘরটিই মাটির গয়না শিল্পের ঠিকানা। ছোট্ট ঘরটুকুতে মাটিতেই মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছেন তপন রাঢ়ী। নবদ্বীপে যাঁদের বাস এগারো পুরুষ ধরে। তপনের হাতের গুণে তাঁর পোড়ামাটির গয়নার চাহিদাও ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু আরও তো অনেকের হাতেই তৈরি হয় এই গয়না। তা হলে?
তপনের গয়নার (পোড়ামাটির) বিশেষত্ব প্রধানত দুটি। এক, প্রতিটি গয়নার দানার আকার আলাদা। ভাল করে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় তা। এটিই কুটিরশিল্পের প্রধান রূপ। দুই, প্রতিটি গয়নার প্রতিটি দানার গায়ে একাধিক বর্ণের উপস্থিতি। একটির সঙ্গে অন্যটির রঙের তফাত। কোনও বাইরে থেকে রং দেওয়া হয় না। পোড়ামাটির কৌশলেই এসে যায় রং-এর রামধনু।
কোন তাপমাত্রায় কোন অঞ্চলের মাটিতে কেমন রং আসে তা গবেষণা করে বের করেছেন তপন। দু’দশকেরও
|
নিজস্ব চিত্র। |
বেশি সময় ধরে মাটির চরিত্র-তাপমাত্রা ও রং নিয়ে রীতিমত তৈরি করে ফেলেছেন একটা ‘ডেটা বেস’। আর এই ‘ডেটা বেস’ই তপনের কাজের ‘ট্রেড সিক্রেট’। কিন্তু এতকিছু থাকতে মাটিকেই মাধ্যম কেন? বাদরাপাড়ার ঘরে বসে শিল্পী শুরু করলেন, “মেজকাকা নীহার রাঢ়ী ছিলেন সে সময়ের বিখ্যাত গয়না শিল্প (ধাতু), প্যাক কোম্পানির (জুয়েলারি) ডিজাইনার। তাঁর উৎসাহে নানা বস্তু, বাঁশ-কাঠ ছেড়ে শেষে এই মাটিতেই মন বসল। প্রায় বাইশ-তেইশ বছর এই মাটি-আগুন আর মাটির নিজস্ব রং নিয়ে পড়লাম। এখন মাটিই আমার সব।” আত্মবিশ্বাস ঝরে পড়ল শিল্পীর গলায়। শিল্পীর ডেরায় দেখা গেল মাটির ইকো-ফ্রেন্ডলি গয়নার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শনটি। প্রায় ত্রিশ ইঞ্চি মাটির চেন। প্রতিটি শিকলিই মাটির। শিকলি দিয়েই গাঁথা। ওজন মাত্র আট গ্রাম। এক কথায় অবিশ্বাস্য!
রেডিও, ঘড়ির যন্ত্রপাতি খুলে ফেলত ছোট্ট ছেলেটি। কারণ ভিতরের রহস্যের প্রতি দুর্নিবার টান। তবে খুলেই ক্ষান্ত হত না সে। আবার তা ঠিক করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিত দারুণ মুন্সিয়ানায়। যন্ত্র খোলা ও মেরামত করার এই গভীর আগ্রহই পরবর্তী কালে তপনকে শুধু শিল্পী নয়, কুটির শিল্পের মিস্ত্রিও করে দিয়েছে।
ফের শুরু করেন শিল্পী, “পোড়ামাটির কাজের জন্যে যত রকমের কাটার, নিডল, ডিজাইন বা শেপ দেওয়ার জন্য প্রেসার কাম কাটার সবই আমার হাতে তৈরি। কেন না ডাইস তৈরি করাতে হলে প্রথমত অনেক খরচ। দ্বিতীয়ত, ডাইস মানে সে যা তৈরি করবে মাটির খণ্ড বা লেচি কেটে, তা হুবহু একই। আমি তা চাই না।” প্রথমে শুরু হয়েছিল বাঁশের গয়না, ছোটখাটো প্রয়োজনীয় শিল্প সামগ্রী দিয়ে। নবদ্বীপের মেলায় তার কদর বেড়েছিল। যেমন কোমরের বেল্ট, ফ্লাওয়ার ভাস। কিন্তু সেগুলি পরের মেলায় নকল হয়ে যেত। তবে এই বাঁশ তাঁকে খ্যাতি দিয়েছে। বাঁশের তৈরি একটি সুদৃশ্য সাইকেল বানিয়েছেন। যা দেখলে সত্যিই চমকে উঠতে হয়। অবশ্যই প্রদর্শনীর জন্য। এই সাইকেলই তাঁকে এনে দিয়েছে জেলা ও রাজ্যস্তরের পুরস্কার। ১৯৯৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত কাজের জন্য জুটেছে জেলা-রাজ্য ও ভিন রাজ্যের একাধিক পুরস্কার। ঝুলিতে উঠেছে পোড়ামাটির ‘সচল’ ঘড়ির জন্য বিশেষ পুরস্কার।
হায়দরাবাদের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব রুরাল ডেভেলপমেন্ট (কুটির শিল্প) তপনের পোড়ামাটির কাজের জন্য শুধু তাঁকে পুরস্কৃতই করেনি, দিতে চেয়েছিল স্থায়ী ডিজাইনারের চাকরিও। সবিনয়ে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন শিল্পী। “ওখানে থেকে গেলে আমার এতগুলো সহকর্মীর কী হত?” বললেন সহমর্মী তপন। |