উত্তর কলকাতা
হাতিবাগান বাজার
দিবারাত্রির আতঙ্ক
লোমেলো ঝুলছে বিদ্যুতের তার। সব্জিবাজার বা মাছ-মাংসের জন্য যে জায়গা, সেখানে টিনের চাল ভাঙা। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দোকানদারেরা প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়ে রেখেছেন। যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে বিড়াল, কুকুর। মাঝেমধ্যেই ছাদের চাঙড় ভেঙে পড়ে। সন্ধ্যায় এখানে আলো এত কম যে অধিকাংশ জায়গাই অন্ধকারে ঢেকে থাকে। বাজারের ভিতর দোকানের মাঝে ফাঁকা জায়গা বলতে দু’-আড়াই ফুট জায়গা। বস্তুত, উত্তর কলকাতার হাতিবাগান বাজারের ছবিটা রীতিমতো বেহাল।
বাজারের প্রবেশপথ মোট সাতটি, তার মধ্যে একটিই বড়জোর দশ ফুট চওড়া। বাকি ছ’টি প্রবেশপথ অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ। তার উপরে প্রবেশপথের বাইরেই হকার বসে প্রবেশপথের মুখগুলি আরও সরু করে ফেলেছে। ফলে অপরিসর জায়গা দিয়ে দু’-তিন জনের বেশি মানুষ একসঙ্গে যাতায়াত করতে পারেন না। প্রায় সাড়ে চার বিঘা জমির উপর এই হাতিবাগান বাজারে সব্জি, মাছ-মাংস থেকে শুরু করে ফুল-ফল, বাসনপত্র, জামাকাপড় মিলিয়ে দোকানের সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি। হকারদের দাপটে বাইরে থেকে এই বেসরকারি বাজারটি প্রায় দেখা যায় না। ভিতরের অবস্থাও শোচনীয়।
তবে, যে জায়গায় রেডিমেড জামাকাপড় বিক্রি হয়, সেই জায়গার ব্যবসায়ীরা টিনের চালের নীচে প্লাই এবং আলো দিয়ে সাজিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, সবই তাঁরা নিজেরা করে নিয়েছেন। মালিকপক্ষের তরফ থেকে বর্তমানে আর কোনও পরিষেবা মেলে না। আরও অভিযোগ, ভাড়ার সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণের টাকা নেওয়া হলেও সাফাইয়ের কাজ ব্যবসায়ী সমিতিগুলি নিজেদের খরচে করে।
কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে পরিস্থিতি যে খুবই খারাপ হবে তা স্বীকার করে নিয়েছে বাজারের তিনটি ব্যবসায়ী সমিতিই। বাজার ঘুরে দেখা গিয়েছে, এত বড় বাজারে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র মাত্র আটটি। ক্রেতা ও বিক্রেতাদের প্রশ্ন, মাত্র আটটি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র নিয়ে কী ভাবে এত বড় বাজার চলছে?
এই বেহাল অবস্থার কথা স্বীকার করে বাজারের মালিকপক্ষের তরফে প্রশান্ত সাহা বলেন, “এত পুরনো বাজারের দোকানদারদের কাছ থেকে যে ভাড়া পাওয়া যায়, তাতে বাজার নতুন করে তৈরি বা সংস্কার করা সম্ভব নয়। দীর্ঘ কাল এ ভাবেই চলে আসছে। আমাদের এ ছাড়া কিছু করার নেই।” কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে বা আগুন লাগলে তা-ও যে ঠেকানো মুশকিল সে কথাও তিনি স্বীকার করে নেন। রাজ্যের দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান বলেন, “প্রতিটি বাজারই পরিদর্শন করা হবে। তবে, হাতিবাগান বাজার পরিদর্শন করা হয়েছে কি না তা আমাকে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।” স্থানীয় ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য ও বস্তি উন্নয়ন) অতীন ঘোষের কথায়: “এটি বেসরকারি বাজার। বাজারটি বিপজ্জনক অবস্থায় না পৌঁছনো পর্যন্ত পুরসভার পক্ষে কিছু করার নেই।”
বাজারে তিনটি ব্যবসায়ী সমিতি। মাছ, মাংস, সব্জি, আলু, ফুল, ফল, বাসন এই সাতটি পট্টি নিয়ে ‘হাতিবাগান বাজার ব্যবসায়ী সমিতি’। প্রায় চল্লিশ বছরের পুরনো এই সমিতির সদস্য সংখ্যা সাতশোর কাছাকাছি। খুচরো ছাড়াও সকালে বাজারের চাতালে বসে পাইকারি বাজার। দূরদূরান্ত থেকে ভোরে চাষিদের কাছ থেকে আড়তদারেরা সব্জি-সহ নানা পসরা নিয়ে হাজির হন এই পাইকারি বাজারে।
হাতিবাগান বাজার ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সম্পাদক অভিজিত সাহা বলেন, “এ ভাবেই বহু বছর ধরে বাজার চলে আসছে। আমরাও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। বাজার নতুন করে সাজানোর প্রয়োজন থাকলেও মালিকপক্ষ কিছু ব্যবস্থা না নেওয়ায় আমরা আর কিছু বলিনি।” একই বক্তব্য আর এক যুগ্ম সম্পাদক রঞ্জন রায়েরও। যদিও বাজারের অন্য দুই ব্যবসায়ী সংগঠন ‘হাতিবাগান বাজার ইউনিয়ন সমিতি’ এবং ‘হাতিবাগান বাজার রেডিমেড ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি’ বাজারের বেহাল অবস্থার কথা স্বীকার করে নিয়েছে। দুই ব্যবসায়ী সমিতির সূত্রেই জানা গিয়েছে, বাজারের ছাদের চাঙড় প্রায়ই ভেঙে পড়ে। ছাদের অবস্থা খুবই খারাপ। তারা জানায়, টিনের ছাদের নীচে প্লাই দিয়ে অস্থায়ী ভাবে ছাদ তাদের সদস্যেরাই তৈরি করে নিয়েছেন। হাতিবাগান বাজার রেডিমেড ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সম্পাদক ভোলা সাউ বলেন, “আমাদের অধিকাংশ সদস্যের রেডিমেড জামাকাপড়ের দোকান হওয়ায় তাঁরা নিজেরাই দোকানগুলি সারিয়ে নিয়েছেন। না হলে ক্রেতারা আসবেন না।”
মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “পুরসভা কলকাতার সব বাজার, শপিং মল, বহুতলে যেমন ঘুরে দেখেছে, তেমনই হাতিবাগান বা বেসরকারি বাজারগুলিও পরিদর্শন করে দেখা হবে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ঠিক আছে কি না।” পাশাপাশি শোভনবাবুও জানান, এই বাজারটি বেসরকারি হওয়ায় যত ক্ষণ না ভবনটি পুরো বিপজ্জনক হয়ে পড়ছে, তত ক্ষণ পুরসভার কিছু করার নেই।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.