অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে শুক্রবার এক দিকে যখন ভারতীয় ক্রিকেটের সমস্ত অহঙ্কার ধুলিসাৎ হচ্ছে, তখন অন্য দিকে তেরঙ্গাটা সগৌরবে উড়িয়ে রাখল লিয়েন্ডার পেজ। মেলবোর্ন পার্কে ডাবলস আর মিক্সড ডাবলসের জোড়া ফাইনালে উঠে অ্যাডিলেড ওভালের লজ্জা অনেকটাই ঢেকে দিয়ে দেশের মুখ রাখল লিয়েন্ডার। এ বারের অস্ট্রেলীয় ওপেন থেকে ওর জোড়া খেতাব আসবে কি না সেটা পরের কথা। কিন্তু সাফ-সাফ বলছি, আটত্রিশ পেরিয়েও ছেলেটা গ্রান্ড স্লাম ডাবলস আর মিক্সড ডাবলসে যা খেলছে, তুলনাহীন! টুপি খুলে ওকে অভিনন্দন জানাচ্ছি! এর পর লিয়েন্ডার পেজকে ভারতের সর্বকালের সেরা ডাবলস খেলোয়াড় বলতে আমার কোনও দ্বিধা নেই।
সচিন তেন্ডুলকর আর লিয়েন্ডারের বয়সটা প্রায় এক। কুড়ি বছরেরও বেশি সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলার পরেও সচিনের খিদে আর ফিটনেস নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়। কিন্তু আমি বলব, সচিনের থেকেও বেশি কৃতিত্ব লিয়েন্ডারের। প্রায় একুশ বছর হল পেশাদার সার্কিটে খেলছে। সচিনের থেকে খিদেটা কোনও অংশে কম নয়। বরং শারীরিক ধকল অনেক বেশি নিয়ে চলেছে।
|
অনেকে বলবেন, লিয়েন্ডার তো শুধু ডাবলস খেলে। মানছি, টেনিসে সিঙ্গলসের সঙ্গে ডাবলসের কোনও তুলনাই হয় না। নিজে খেলেছি বলে আরও ভাল জানি। পুরো কোর্ট আর অর্ধেক কোর্টে খেলার মধ্যে বিস্তর তফাত। তবু ডাবলসেও আন্তর্জাতিক টেনিস খেলোয়াড়ের কাছ থেকে ক্রিকেটের তুলনায় আনেক, অনেক বেশি শারীরিক সক্ষমতা দাবি করে। ক্রিকেটে তো তাও ঘণ্টা দুই পর পর বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ থাকে, ড্রিঙ্কস, লাঞ্চ, টি... টেনিসে কিন্তু ঘন্টার পর ঘন্টা একটানা লড়াই। যেখানে তুমি একা। খুব বেশি হলে ডাবলস পার্টনার সঙ্গী। রণকৌশল সাজানো, মনস্তাত্বিক চাল ঠিক করা, প্রতিপক্ষের তৈরি চাপ সামলানো-- সব নিজেকে করতে হয়। সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ ভাবে এতগুলো বছর একটানা খেলে চলা ভীষণ কঠিন কাজ। অমানুষিক পরিশ্রম তো বটেই, নিজেকে এতগুলো বছর তাতিয়ে চাগিয়ে চলাটাও প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। লিয়েন্ডার কিন্তু সেই অসম্ভবটাই সম্ভব করে দেখিয়ে চলেছে। আর যে ভাবে খেলছে, তাতে ওর থামার কোনও কারণও তো দেখছি না।
নতুন মরসুমের গোড়ায় শারীরিক ভাবে বেশি তাজা থাকে লিয়েন্ডার। মেলবোর্নে ওর খেলার ভেতর সেটা ধরা পড়ছে। কিন্তু সে তো বছর শেষে পাঁচ-সাত সপ্তাহ বিশ্রাম সার্কিটে অন্যরাও পেয়েছে। ঠিক গত বছরের মতোই ‘টিম লিয়েন্ডার’ অস্ট্রেলীয় ওপেনে পুরুষ ডাবলসের ফাইনালে উঠল কোয়ার্টার ফাইনালে বিশ্বের তৃতীয় সেরা (লোদরা-জিমোনজিচ) আর সেমিফাইনালে দ্বিতীয় সেরা (মির্নি-নেস্টর) টিমকে হারিয়ে। ফাইনালেও ঠিক আগের বারের মতোই সামনে বিশ্বসেরা ব্রায়ানরা। কিন্তু গত বার লি-হেশকে স্ট্রেট সেটে হারতে হলেও এ বার লিয়েন্ডার-স্টেপানেক জুটি নিয়ে আমি বেশি আশাবাদী। শনিবার ফাইনাল আমার মতে ৫০-৫০। সিডনিতে দু’সপ্তাহ আগে ওরা ব্রায়ান ভাইদের কাছে হারলেও দু’টো সেটই টাইব্রেকারে গিয়েছিল। তবে বব আর মাইকের ডান-বাঁ হাতি কম্বিনেশনটা অবশ্যই দুশ্চিন্তার। ডাবলস ম্যাচে এ রকম কম্বিনেশন বিপক্ষের কাছে মারাত্মক।
মিক্সড ডাবলসে তিন বছর আগের চ্যাম্পিয়ন সানিয়া-মহেশ জুটি এ দিন সেমিফাইনালে খুব খারাপ খেলে তেকাউ-মাটেকের কাছে ৩-৬, ৩-৬ হারল। কিন্তু মিক্সড ডাবলস খেতাবও ভারতে আসতে পারে। অনামী ভিঞ্চি-ব্রাসিয়ালিকে সুপার টাইব্রেকে ৫-৭, ৬-২ (১০-৭) হারিয়ে লিয়েন্ডার-ভেসনিনা জুটি ফাইনাল পৌঁছনোয়। ইন্দো-রুশ জুটি ফাইনালে পরিষ্কার ফেভারিট।
২০০৯ যুক্তরাষ্ট্র ওপেনেও দুটো ডাবলসের ফাইনালে উঠেছিল লিয়েন্ডার। পুরুষ ডাবলসে ট্রফি জিতলেও মিক্সড ডাবলসে পারেনি। মেলবোর্নে হয়তো উল্টোটাই ঘটবে। যদিও সব ভারতীয়ের মতো আমিও চাই জীবনের প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম ‘ডাবল’টা সামনের দু’দিনে করুক চিরসবুজ লিয়েন্ডার। ও যে আমাদের টেনিসে ‘ওল্ড ওয়াইন ইন নিউ বটল্’! |