সহানুভূতি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আবেগ। এই আবেগটি না থাকিলে সভ্যতাও থাকিত না, যাহা থাকিত তাহার নাম বর্বরতা। আর সামাজিক অবস্থানের মাপকাঠিতে যাঁহাদের অবস্থান অনেক দূরে, অনেক নিম্নে, তাঁহাদের প্রতি সহানুভূতি আরও মহৎ। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী বেশ কয়েক বার সেই মহৎ আবেগের প্রকাশ ঘটাইয়াছিলেন। কিন্তু, কোনও সাধারণ মানুষের পক্ষে যে কথা উচ্চারণ করা প্রশংসার্হ, রাজ্যের রাজ্যপালের ক্ষেত্রে তাহা ভুল, অনৈতিক। তাহার কারণ তিনি কোনও সাধারণ মানুষ নহেন, সংবিধান অনুসারে তিনি সমগ্র রাজ্যবাসীর ঊর্ধ্বে, রাজ্য প্রশাসনের ঊর্ধ্বে। সংবিধান তাঁহাকে যে মর্যাদা দিয়াছে, তাহা রক্ষা করিবার নৈতিক দায়িত্ব তাঁহারই। রাজ্য সংক্রান্ত কোনও বিষয়ে রাজ্যপালের মতামত থাকিতেই পারে। কিন্তু প্রকাশ্যে সেই মতামত ব্যক্ত করা তাঁহার পক্ষে অনুচিত। যাহা বলিবার, তিনি তাহা রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান, অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রীকে একান্তে বলিতে পারেন।
সত্য, রাজ্যপালের এই আচরণবিধি কোনও আইন দ্বারা নির্দিষ্ট নহে। প্রকাশ্যে মন্তব্য করিবার আইনি অধিকার তাঁহারও আছে। কিন্তু, আইনই শেষ কথা নহে। কিছু অলিখিত নৈতিক সীমানা থাকে, যাহা লঙ্ঘন করা অন্যায় না হইলেও অনৈতিক। রাজ্য প্রশাসনকে এড়াইয়া প্রকাশ্যে মন্তব্য করিবার ঘটনাটি সেই অলিখিত সীমানার অ-নৈতিক পার্শ্বে অবস্থান করে। গোপালকৃষ্ণ গাঁধী সীমানা লঙ্ঘন না করিবার নৈতিক কর্তব্য পালনে একাধিক বার ব্যর্থ হইয়াছিলেন। তাঁহার উত্তরসূরি এম কে নারায়ণন পূর্বে কয়েক বার এই সীমার সমীপবর্তী হইয়াছিলেন বটে, কিন্তু তাহা লঙ্ঘন করেন নাই। তাঁহাকে দেখিয়া প্রত্যয় জন্মিতেছিল যে তিনি বুঝি তাঁহার পদের মর্যাদার কথাটি সম্যক বুঝিয়াছেন। কিন্তু কৃষক-আত্মহত্যার প্রসঙ্গে তাঁহার সাম্প্রতিক মন্তব্যটি সেই প্রত্যয়কে ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করিল। তিনি তাঁহার পূর্বসূরির অনুগামী হইলেন। রাজ্যপাল পদটির মর্যাদা-লঙ্ঘনের পথে।
‘রাজ্যপাল’ পদটির গুরুত্ব কী, সেই পদে যিনি আসীন হইবেন, তাঁহার কর্তব্যই বা কী, এই প্রশ্নগুলির উত্তর জনমানসে স্পষ্ট নহে। পদটি প্রায় সম্পূর্ণতই আলঙ্কারিক, বস্তুত অপ্রয়োজনীয়। দৈনন্দিন প্রশাসনে রাজ্যপালের কোনও ভূমিকা নাই। তবুও, পদটি যখন আছে, তখন সেই পদাধিকারীর কর্তব্য সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা থাকা ভাল। তাঁহার রাজনৈতিক আনুগত্য, তাঁহার সামাজিক মত, তাঁহার সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি কিছুই জনসমক্ষে প্রকাশ করিবার নহে। বস্তুত, দেশের রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যের রাজ্যপালের উচিত, নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকারটিও প্রয়োগ না করা। যিনি তাঁহার পদাধিকারে সকল রাজনীতির ঊর্ধ্বে, তিনি নির্বাচনে কোনও বিশেষ প্রার্থী বা দলকে সমর্থন করিবেন কেন? আর, কোনও প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে বা অন্যত্র মত প্রকাশের তো প্রশ্নই উঠে না। বিশেষত, এই মতপ্রকাশটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শাসক দলের সমালোচনায় পর্যবসিত হয় এবং তাহাতে রাজ্যপালের একটি রাজনৈতিক অবস্থান সর্বসমক্ষে প্রকট হইয়া উঠে। তিনি নিজের মত গোপন রাখিবেন, ইহাই তাঁহার নিকট তাঁহার কাজের দাবি। বাক্-সংযম বস্তুটি নেহাত ফেলনা নহে। কেহ তাঁহাকে প্রশ্ন করিতেই পারেন, কিন্তু উত্তর না দিবার অধিকার তাঁহার বিলক্ষণ রহিয়াছে। অধিকারটি প্রয়োগ করুন। অভিজ্ঞতায় দেখা যাইতেছে, অধিকাংশ রাজ্যপালই নিজেদের পদের মহিমা সম্বন্ধে উদাসীন। যদি ইহাই সাবির্র্ক প্রবণতা হইয়া দাঁড়ায়, তবে ভাবিতে হইবে যে এই পদটি আদৌ আর রাখা উচিত কি না। |