চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
মাতৃরূপিণী ও শক্তিরূপিণীর দ্বৈত প্রকাশ
নাতন ভারতীয় শিল্পে, ভাস্কর্যে বিশেষত, মানবী প্রতিমা সৃজনের যে ধারাবাহিকতা, তার দু’টি দিক। এর প্রধান একটি ধারা মাতৃশক্তি। অন্যটিকে বলা যায় প্রেমিকারূপিণী বা কামনারূপিণী নারী, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ইরটিক’।
শরীরীচেতনা ও অধ্যাত্মচেতনা, এই দু’টি দিকেই ভারতীয় শিল্পী পরম প্রজ্ঞার পরিচয় জ্ঞাপক। অনেক ক্ষেত্রে এই দুই চেতনা মিলেও গেছে। কিন্তু আধুনিক কালের অনেক তাত্ত্বিকই মানবীমূর্তির ক্ষেত্রে শরীরীচেতনার বা ‘ইরটিসিজম’-এর সার্বিক প্রাধান্যের কথা বলেছেন।
কামনারূপিণীই যে ভারতীয় শিল্পে মানবী-রূপায়ণের প্রধান ধারা নয়, মাতৃশক্তিও যে এর মধ্যে বিপুল অবস্থানে রয়েছে, তা দেখা গেল ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম আয়োজিত আশুতোষ শতবার্ষিকী হলে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ‘শক্তিরূপেণ’ প্রদর্শনীতে। ভারতীয় শিল্পে মাতৃশক্তির বিবর্তন এই প্রদর্শনীর প্রধান উপজীব্য। মোট ১০৬টি ভাস্কর্য ও চিত্রের মধ্য দিয়ে এই বিকাশকে তুলে ধরা হয়েছে একেবারে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের সিন্ধু সভ্যতা থেকে ঊনবিংশ-বিংশ শতকে কালীঘাটের পট, বাংলার অনামা শিল্পীদের স্বাভাবিকতা-আশ্রিত তেলরঙের ছবি, অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু পর্যন্ত বিস্তারের মধ্য দিয়ে।
পৃথিবীর সমস্ত প্রাচীন সভ্যতাতেই মাতৃমূর্তি ও প্রজায়িনী শক্তির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল অস্তিত্বরক্ষা ও বংশবৃদ্ধি এবং খাদ্য উৎপাদনের প্রয়োজনে। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই এর পরিচয় পাওয়া যায়। ব্যাবিলন, অ্যাসিরিয় ও মিশরীয় সভ্যতাতেও মাতৃরূপের অনুধ্যান ছিল। সেটাই ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়ে একদিকে মাতৃরূপিণী বা শক্তিরূপিণী, অন্যদিকে কামনারূপিণী নারীসৌন্দর্যের দিকে বিকশিত হয়েছে।
এই প্রদর্শনীতে আমরা দেখতে পাই কেমন করে মাতৃরূপিণী শক্তিরূপিণীতে রূপান্তরিত হয়েছে। এই শক্তিরূপিণীর আবার নানা রকম প্রকাশ আছে। কখনও সে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা, কখনও কালী, কখনও জগদ্ধাত্রী, এমনকী পার্বতী, লক্ষ্মী ও সরস্বতী রূপেও সেই মানবীরূপের বা দেবীরূপের প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়।
প্রদর্শনীর একটি ভাস্কর্য
এমনকী দক্ষিণ ভারত থেকে অষ্টাদশ শতকের একটি রাম-সীতা ও হনুমানের মূর্তিও রয়েছে। বিহারের তারা, বসুধারা, ওড়িশার জাঙ্গুলি, গুজরাটের ভদোদরার অম্বিকা, তাঞ্জোরের শ্রীদেবী ও ভূদেবী, তামিলনাড়ুর আম্মান, বাংলার মনসা এ সবই মাতৃরূপিণী বা শক্তিরূপিণীর বিভিন্ন প্রকাশ। এই এক একটি রূপের মধ্য দিয়ে এক একটি অঞ্চলের মানবগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও ধর্মচেতনার বিভিন্ন দিকও প্রতিফলিত হয়।
হরপ্পার মাতৃদেবীমূর্তির তিনটি ছোট টেরাকোটা রয়েছে এই প্রদর্শনীতে। সেগুলি খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় সহস্রাব্দের। মাতৃরূপের যে কল্পনা সিন্ধু সভ্যতার যুগে ছিল, তার কিছু স্বরূপ এই মূর্তি থেকে পাওয়া যায়।
পরবর্তী কালের বৈদিক সভ্যতায় অবশ্য পুরুষশক্তিরই প্রাধান্য ছিল। তবে বৈদিক সাহিত্যেও পুরুষ দেবতার সহযোগিনী বা স্ত্রী হিসেবে অনেক দেবীর কল্পনাও আছে। যেমন ঊষা, ইলা, সরস্বতী, অদিতি, পৃথ্বী, রাকা ইত্যাদি। সিন্ধু সভ্যতার মাতৃরূপ বিভিন্ন আদিম মানবগোষ্ঠীর কল্পনা ও লোকাচারের মধ্য দিয়ে রূপান্তরিত হতে হতে পরবর্তী কালের শক্তিরূপিণীতে এসে পৌঁছেছে, যার প্রকাশ আজও আমরা দেখি দুর্গা, কালী বা জগদ্ধাত্রী মূর্তিতে।
খ্রিষ্টিয় দ্বিতীয় শতকে উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের যে যক্ষ্মীমূর্তি রয়েছে এই প্রদর্শনীতে সেগুলি আদিমতা থেকে ধ্রুপদী চেতনার দিকে রূপান্তরণের সাক্ষ্য বহন করে। এর মধ্যে ভারহুতের ‘গজ-লক্ষ্মী’ ও উত্তর ২৪ পরগনার চন্দ্রকেতুগড়ের যক্ষ্মীমূর্তি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই প্রদর্শনীতে প্রথম ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র মূর্তি দেখতে পাই সপ্তম শতকে উত্তরপ্রদেশ থেকে সংগৃহীত বেলে পাথরের রূপায়ণটিতে।
পরবর্তী কালে এই মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা কখনও সিংহবাহিনী, কখনও ব্যাঘ্রবাহিনী হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ভাবে রূপায়িত হয়েছে। এর মধ্যে দ্বাদশ শতকের হায়দরাবাদের কালো পাথরে তৈরি ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।
নগ্নিকা মূর্তিতে রূপের সংহতি ও বলিষ্ঠতা। এবং একই সঙ্গে যে নান্দনিক উদাত্ততা সেটা ভারতীয় ভাস্কর্যে লৌকিক ও অলৌকিকের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। যা অসামান্য এক দৃষ্টান্ত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.