নিয়ম রয়েছে। রয়েছে নিয়মের ফাঁকও।
তাই ঠিকানা না-থাকলে জননী সুরক্ষা যোজনায় নাম তোলা যায় না। এবং অধিকাংশ ফুটপাথবাসী ঠিকানা দিতে পারেন না বলে তাঁদের নাম ওঠে না। যদিও বা ওঠে, অনেকের হাতেই টাকা এসে পৌঁছয় না।
নিয়ম অনুযায়ী জননী সুরক্ষা যোজনায় দারিদ্রসীমার নীচের (বিপিএল) মহিলারা হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তিন বার শারীরিক পরীক্ষা করালে পাঁচশো টাকা ও একটি কার্ড পান। সেই কার্ড সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে সন্তানের জন্ম দিলে আরও পাঁচশো পাওয়ার কথা। কলকাতায় পুরসভা এবং স্টেট আরবান ডেভলপমেন্ট এজেন্সি-র মাধ্যমে যোজনার টাকা বণ্টনের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু সেই ব্যবস্থা যে যথাযথ কাজ করে না, সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্তারা কার্যত তা মেনে নিয়েছেন।
আর আশ্চর্য, দরিদ্র পরিবারের গর্ভবতী-প্রসূতিদের উপরে সরকারি নজরদারির ক্ষেত্রে গ্রামের চেয়েও শহর পিছিয়ে!
গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্য-কর্মীরা ঘুরে ঘুরে অন্তঃসত্ত্বাদের আয়রন ট্যাবলেট দেন, নানান পরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা করেন। নির্দিষ্ট সময়ে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাতে প্রসব হয়, সেটাও দেখেন। অথচ শহরে তা নেই। কলকাতায় পাঁচ হাজার জনসংখ্যাপিছু এক জন স্বাস্থ্য-সহায়িকা (এএনএম) থাকার কথা। অথচ গোটা কলকাতায় মেরেকেটে ৪০ জন এএনএম-ও নেই। কলকাতা পুরসভার চিফ হেল্থ অফিসার দীপঙ্কর দাস জানাচ্ছেন, পুরসভার যে চারটি মাতৃসদন, সেই দর্জিপাড়া, খিদিরপুর, গার্ডেনরিচ ও ক্রিস্টোফার রোডের চম্পামণি মেটারনিটি হোমে কলকাতার গরিব প্রসূতিরা নিখরচায় পরিষেবা পেতে পারেন। কিন্তু ঘটনা হল, এত দিনেও এগুলোয় সিজারের ব্যবস্থা হয়নি।
ফলে প্রসবের সময়ে জটিলতা দেখা দিলে সবটাই ‘ভাগ্যের’ উপরে ছেড়ে দিতে হয়। কলকাতার জেলা স্বাস্থ্য-আধিকারিক সুকুমার দে’র আক্ষেপ, “আমরা শুধু রুটিন টিকাকরণ করি। গোটা পাঁচ-ছয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ছাড়া মা-শিশুদের নিয়ে কলকাতায় সরকারি বা পুরস্তরে বিশেষ কাজ হয় না।”
কেন হয় না?
স্পষ্ট উত্তর কেউ দিতে পারেননি। পুর-কর্তাদের দায়সারা জবাব, “এত দিন রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের কোনও সমন্বয় ছিল না। এখন সেটা তৈরি হচ্ছে। আশা করা যায়, পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে।” স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদেরও একই বক্তব্য। এগারো সন্তানের জননী ঊষা তাঁতির প্রসবকালীন মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্য-সচিব সঞ্জয় মিত্র মন্তব্য করেছিলেন, “হাম দো, হামারা দো ওঁরা মানেননি।” কিন্তু এই স্লোগান ওঁদের মর্মে পৌঁছানোর দায়িত্ব কি সরকারেরও নয়?
সেই প্রশ্নেও সকলে নীরব। রাজ্যের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কমিশনার দিলীপ ঘোষ বলেন, “পরিষেবা আরও বাড়াতে হবে। শহরাঞ্চলেও সাব সেন্টার থাকা দরকার। দরকার হাসপাতালের পিপি (পোস্ট পার্টাম) ইউনিটে বস্তি-ফুটপাথবাসী মা ও শিশুকে সময়ে নিয়ে আসা। কিন্তু এত লোক কোথায়?”
ফলে কাজও হয় না। কালীঘাটের ফুটপাথবাসিনী ঝিমলি হালদারের চার সন্তান। চার জনেরই জন্ম ঝুপড়িতে। ঝিমলি বলছেন, “কখনও এখানে থাকি। কখনও গার্ডেনরিচে বোনের বাড়িতে। কয়েক জন দিদি এসে বাচ্চাদের পোলিও খাওয়াতে বলেন। কিন্তু বাচ্চা হওয়ার আগে হাসপাতালে কার্ড করানোর জন্য কেউ চাপাচাপি করেনি। ঝামেলা ভেবে আমরাও যাইনি।” ঊষা তাঁতির ঝুপড়ির অদূরে অন্য এক ঝুপড়িতে থাকেন সুমিত্রা পয়রা। তাঁর দুই সন্তান। তৃতীয় বার সন্তানসম্ভবা বধূটির আক্ষেপ, “কার্ড করানোর চেষ্টা করেছিলাম। নাম ওঠেনি। তাই আর ও সব ভাবি না। হাসপাতালে বাচ্চা হওয়া, বাচ্চা হওয়ার পরে টাকা পাওয়া ও সব আমাদের জন্য নয়।”
কলকাতায় ‘কলকাতা স্লাম ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট’ এবং ‘কলকাতা আর্বান ডেভলপমেন্ট প্রজেক্ট’-এ স্বাস্থ্য উন্নয়নের কিছু কাজ হয় বটে, তবে তাতে তিন হাজার মানুষপিছু কর্মী সাকুল্যে এক জন। ফলে তাঁদের পক্ষে কার্যত কোনও পরিষেবাই সামলানো সম্ভব হয় না। পুর-কর্তারাও স্বীকার করছেন যে, কোনও ওয়ার্ড স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গর্ভবতীর শারীরিক পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। এমনকী, গর্ভবতী হয়েছেন কি না জানতেও গাড়ি ভাড়া দিয়ে হাসপাতালে যেতে হয়।
উপরন্তু এক দিনের রুটি-রুজি ছেড়ে গরিব মহিলার পক্ষে হাসপাতালে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করা সম্ভব হয় না বলে অনেক ক্ষেত্রে মা ও শিশুর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা, টিকাকরণও হয় না।
এ দিকে গর্ভবতীকে প্রসবের জন্য নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে স্বাস্থ্য দফতর যে ‘মাতৃযান’-এর ব্যবস্থা করেছে, তা জেলায় চালু হলেও কলকাতা শহরে হয়নি। তাই রাত-বিরেতে বস্তি বা ঝুপড়িবাসী কোনও মহিলার প্রসবযন্ত্রণা শুরু হলে অপরিসর, ময়লা ঘরে সংক্রমণের পূর্ণ আশঙ্কা নিয়ে সন্তান প্রসব করা ছাড়া তাঁর উপায় থাকে না।
ঊষা তাঁতিদের উপাখ্যানেরও অন্ত দেখা যাচ্ছে না।
|