এক জন ২৬ দিন অনশন করেছেন। এখন মহাকরণে।
অন্য জন ১১ বছর অনশনরত। এখনও হাসপাতালে বন্দি।
দু’জনের দেখা হল আজ। একেবারে নিজস্ব কায়দায় সরকারি অনুমতির তোয়াক্কা না করেই শর্মিলা ইরম চানুর বিছানার পাশে পৌঁছে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে জড়িয়ে ধরে আশ্বাস দিলেন, আফস্পা প্রত্যাহারের জন্য লড়াই করবেন।
মণিপুরে বিধানসভা ভোটের প্রচারে এসে মমতা শর্মিলাকে দেখতে যেতে পারেন, এমন খবর হাওয়ার ভাসছিল গত কাল থেকেই। আজ, মমতার বিমান ইম্ফল নামার আগে পর্যন্ত, তাঁর ব্যক্তিগত রক্ষীরা ডিএসপি, এসপি-কে যত বার বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু হাসপাতালে যাবেন, তত বারই, নারাজ হয়েছেন পুলিশ কর্তারা। বলেছেন, দিল্লি এবং ডিজি-র অনুমতি ছাড়া জেল হেফাজতে থাকা শর্মিলার সঙ্গে দেখা করা অসম্ভব। সেই অনুমতি পেতে লাগে অন্তত দু’মাস।
কিন্তু অপেক্ষা তো তাঁর ধাতে সয় না। তাই বিমানবন্দরে নেমেই মমতা কনভয়কে নির্দেশ দিলেন, “শর্মিলা চানুর কাছে চলো।” আর মণিপুর পুলিশের ব্যূহ ভ্যাবাচাকা খেয়ে দেখল, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর পিছুপিছু ‘বহিরাগত’ সাংবাদিকের দল হাসপাতালমুখী। একেবারে সোজা শর্মিলার খাটের সামনে গিয়ে থামল সেই ‘কনভয়’। বরখাস্ত হওয়ার আশঙ্কায় সিঁটিয়ে থাকা পুলিশরা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যাকে বললেন, ‘গেট ক্র্যাশ’!
শর্মিলার সঙ্গে অবশ্য গত কালই গোপনে, দেখা করে এসেছিলেন, তৃণমূলের তরফে মণিপুরের পরিদর্শক সৌরভ চক্রবর্তী। তাই, চানু তৈরিই ছিলেন। মমতার সঙ্গে ছিলেন, মুকুল রায়, কে ডি সিংহ, প্রদেশ সভানেত্রী কিম গাংতে। ‘ব্রাত্য’ শর্মিলাকে বাইরে থেকে সমর্থন জানালেও, এ ভাবে দেখা করতে আসেননি কোনও মুখ্যমন্ত্রী। মমতার দেওয়া কার্বি শাল পেয়ে খুশি চানু তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। মমতা বললেন, “অনেক লড়েছেন একা। এ বার, আমাদের যা করার করতে দিন। আপনাকেও বাইরে এসে দাঁড়াতে হবে। হাল ধরতে হবে।” |
চানু বললেন, “আমি নিজের কথা ভাবি না, আমার দাবির কী হবে?” মমতার জবাব, “বিবেচনা করছি সব।” “শুধু বিবেচনা”, চানু হতাশ। সতর্ক মমতা সঙ্গে সঙ্গে কিমের হাত থেকে দলীয় ইস্তাহার টেনে নিয়ে মেলে ধরলেন শর্মিলার সামনে। “এই দেখুন। ক্ষমতায় এলে, মানবাধিকার ভঙ্গকারী আইন তুলে ছাড়ব আমরা।” ফের এক প্রস্ত কুশল বিনিময়। ফ্ল্যাশের ঝলকানি। পুলিশ কোনও মতে হাতজোড় করে হাসপাতাল থেকে বের করল সকলকে।
হাসপাতাল থেকে ধুলোমাখা পথ পার হয়ে লাইজং আচৌবার মাঠ। মঞ্চে বসেই, কিমের কাছে চায়ের আবদার। উদ্ধোধনী সঙ্গীতে মণিপুরের কিশোর কণ্ঠীর গান। প্রথমে কে ডি সিংহের নাতির্দীঘ, পরে, কিম গাংতের ইংরাজি ও মেইতেই ভাষায় ‘সুদীর্ঘ’ বক্তৃতার পরে, মমতার হাতে সময় ছিল আধ ঘণ্টা। কিম, এর মধ্যেই, মমতার হয়ে মণিপুরবাসীকে আশ্বাস দিলেন, “দিদি যেমন তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আপস করেননি, নাগালিম নিয়েও করবেন না। মণিপুরের কোনও অংশ নাগাদের হাতে যেতে দেবেন না মমতা।”
অবশ্য, গুটিকয় মেইতেই শব্দ, আফস্পা, কংগ্রেসি দুর্নীতির অভিযোগ বাদে অন্য খুঁটিনাটি মমতার জানার কথা নয়। তাই, প্রথম থেকেই, রাজ্যের রাজনীতির ভিতরে না ঢুকে, সদ্য শেখা মণিপুরিতে ‘আমার ভাই বোনেরা’, তৃণমূলকে জয়ী করুন’ বলে আসর মাতালেন তিনি। বৈষ্ণবপ্রধান মণিপুরের ‘মহাসভায়’ বাংলার তৃণমূলি ছড়া ফিরিয়ে এনে স্লোগান তুললেন “হরে কৃষ্ণ হরে হরে, তৃণমূল ঘরে ঘরে।”
মমতা বললেন, “১০ বছর আগে, নেতাজির স্মৃতিভবনে এসেছিলাম। তিনি দেশকে বিদেশি শাসনমুক্ত করার পতাকা তুলেছিলেন এই রাজ্যে।
আমাদের হরফ এক। বৈষ্ণব ধমের্র সঙ্গে যোগ অবিচ্ছেদ্য। তাই, মণিপুরকে সবুজ মণিপুর করে তোলাটাই আমাদের লক্ষ্য।” তাঁর দাবি, “যদি আট মাসে, জঙ্গলমহল ঠাণ্ডা করে দিতে পারি, তবে, মণিপুরকেও শান্ত করে দেব, জেলে থাকা আন্দোলনকারীদেরও মুক্তি দেব। সরিয়ে দেব সেনাশাসন, অন্যায় আইন।” এর পর, বাংলায় তাঁর নতুন শিক্ষানীতি, কৃষি প্রকল্প, শিল্পায়নের ছোট্ট ফিরিস্তি দিয়ে মমতার প্রতিশ্রুতি, ক্ষমতায় এলে, বাংলার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এ রাজ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প ও পর্যটনের বিকাশ শুরু করবে তৃণমূল। সেই সঙ্গে, তফশিলি জাতি-উপজাতিদের বিকাশ নিয়েও কোমর কষে লাগবে।
এ বারের মতো মহিলা প্রার্থী মণিপুরের ইতিহাসে কখনও দাঁড়াননি। মোট ১৬ জন। মমতার কথায়, “যে রাজ্যে মহিলারা আন্দোলনের পুরোভাগে থাকেন, সংসার সামলান, রোজগার করেন, সেই রাজ্যে মহিলাদের কোনও ক্ষমতাই নেই। আমরা ক্ষমতায় এলে ‘মেইরা পইবি’ও আরও ক্ষমতা পাবে।”
মমতার ইংরাজি বক্তৃতা, মেইতেই ভাষায় অনুবাদ করছিলেন কিম। নিজের ভাষায় রং-ও চড়ালেন খানিক। চেটেপুটে উপভোগ করল হাজার তিনেকের ভিড়। শেষ পাতে, সর্বধর্মসমন্বয়ের লক্ষ্যে হরে কৃষ্ণ, ইন্শা আল্লা, যিশুর জয়ধ্বনি। তবে, শিখদের উদ্দেশে মমতা ‘ওয়াহে গুরুজি কি খালসা, ওয়াহে গুরুজি কি ফতেহ্’ বলার পরে, কথা জড়িয়ে গিয়ে, অনুবাদকের ভূমিকা থেকে ‘পদত্যাগ’ করলেন বেচারি কিম।
আজ বিমানবন্দর থেকে যেখানেই গিয়েছেন মমতা, জঙ্গি হুমকি অগ্রাহ্য করে, পতাকা হাতে স্বাগত জানাতে হাজির ছিল মেয়েরা। তিনি মঞ্চ থেকে নেমে বিদায় নেওয়ার সময়ও নাগাড়ে স্লোগান চলল, ‘টা টা দিদি। ট্রিনামুল (এটাই এখানে বানান) জিন্দাবাদ’।
বাইরের সিনেমা, বাইরের বোতলবন্দি জলও যে রাজ্যে নিষিদ্ধ, সেখানে, ‘বহিরাগত দিদির’ জন্য এমন অভ্যর্থনা চমকপ্রদ বইকি। আর ‘দিদি’ বলে গেলেন, “ক্ষমতায় আনুন। পরের বার হাতে সময় নিয়ে আসব।” |