নাগালের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। উপরন্তু যাতায়াতের অসুবিধে। গ্রামাঞ্চলে গর্ভবতী সব মহিলার প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব না-হওয়ার জন্য মূলত এই দুই সমস্যার যুগলবন্দিকেই দায়ী করেছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু শহরাঞ্চলেও কি সবার প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব হচ্ছে?
বস্তুত খাস কলকাতার বুকেও যে সব মহিলা প্রসবের জন্য হাসপাতালে যাচ্ছেন না, ফুটপাথের ঝুপড়িবাসিনী ঊষা তাঁতির মৃত্যু তা সামনে এনে দিয়েছে। সম্প্রতি তৃণমূলের পঞ্চায়েতিরাজ সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন, তাঁর সরকার আসন্নপ্রসবাদের হাসপাতালে পৌঁছে দিতে গাড়ির ব্যবস্থা করেছে। যদিও ঊষাদেবী সেই সুবিধা পাননি। ঝুপড়িতে যমজ শিশুর জন্মদানের পরে ব্লেড দিয়ে ওই সদ্যপ্রসূতির নাড়ি কেটেছিলেন তাঁর স্বামী। এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
শুধু ঊষা তাঁতি নন। স্বাস্থ্য দফতরের নিজস্ব পরিসংখ্যানই বলছে, গত এক বছরে মহানগরে অন্তত ৩৫টি শিশুর জন্ম হয়েছে খোলা ফুটপাথে বা ঝুপড়িতে। যে তথ্যকে ‘হিমশৈলের চূড়া’ বলে অভিহিত করছেন অনেকে। তাঁদের দাবি, শহরের সব ফুটপাথ, বস্তি ও ঝুপড়িবাসীকে হিসেবে ধরলে সংখ্যাটা দ্বিগুণের বেশি হবে। প্রাথমিক সমীক্ষার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য-কর্তারাও জানাচ্ছেন, তপসিয়া-তিলজলা-ট্যাংরা-মেটিয়াবুরুজ-বেলেঘাটার বস্তি ও ফুটপাথবাসীদের ক’জন গর্ভবতী হচ্ছেন, ক’জনের বাড়িতে বা ফুটপাথে প্রসব হচ্ছে, কিংবা কত শিশু ও প্রসূতির মৃত্যু হচ্ছে এ সবের কোনও হিসেব কলকাতা পুরসভা বা স্বাস্থ্য দফতরের হাতে নেই।
যাতায়াতের সুবিধা ও নাগালের মধ্যে হাসপাতাল থাকা সত্ত্বেও শহরের সমস্ত মহিলাকে প্রসবের জন্য হাসপাতালে পাঠানো যাচ্ছে না কেন? জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের ধাঁচে শহরে যে নগর স্বাস্থ্য মিশন চালুর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তারই বা কী হল?
স্বাস্থ্য-কর্তারা স্বীকার করছেন, হাসপাতাল-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসবের বিষয়ে প্রত্যন্ত গ্রামে আগ্রহ বাড়লেও শহরবাসীদের একাংশকে এখনও সচেতন করে তোলা যায়নি। তাঁদের পরিবারে আকছার ফুটপাথ বা ঝুপড়িবাড়িতে প্রসব হচ্ছে, ছুরি-ব্লেড দিয়ে বিপজ্জনক ভাবে নাড়ি কাটাও চলছে। ফলে অনেক সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বা সংক্রমণের জেরে জীবনান্ত ঘটছে প্রসূতির। যেমন ঘটেছে ঊষা তাঁতির। এর আগে তাঁর ১১টি সন্তান হয়। পরিজনেরা জানাচ্ছেন, প্রতিবারই প্রসব হয়েছে ঝুপড়িতে। এ বার প্রসবের আগে চিত্তরঞ্জন সেবাসদনে কার্ড করিয়েছিলেন। তাঁর এক পড়শির কথায়, “জননী সুরক্ষা যোজনায় টাকা মিলবে জেনে কার্ড করিয়েছিল। শেষরক্ষা হল না।”
ঊষাদেবীর বাড়ির লোকের অভিযোগ ছিল, মহিলাকে মূমুর্ষু অবস্থায় চিত্তরঞ্জন সেবাসদনে নিয়ে যাওয়া হলেও ভর্তি করা হয়নি। অন্য দিকে হাসপাতালের দাবি: ঊষাদেবীকে মৃত অবস্থাতেই আনা হয়েছিল। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অবশ্য অভিযোগ: হাসপাতাল থেকে প্রসূতি ফেরানো হয় না বলে সরকার যতই দাবি করুক, নাম লেখানো না-থাকলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রসূতিকে ফিরে আসতে হয়। সরকারি হাসপাতালে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে প্রবীণ স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়ও বলছেন, “অশিক্ষিত, ফুটপাথবাসী মহিলারা অনেকে নিয়ম-কানুন না-জেনে হাসপাতালে চলে যান। আগাম বুকিং না-থাকলে ঝুপড়ি রাস্তাই ওঁদের প্রসবের জায়গা হয়ে ওঠে।” এসএসকেএমের স্ত্রী-রোগ বিভাগের প্রধান চিকিৎসক তরুণকুমার ঘোষের দাবি, “কার্ড করানো না-থাকলেও আমরা কখনও কোনও প্রসূতিকে ফেরাইনি।”
বস্তিতে কর্মরত বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জানাচ্ছে, কলকাতার ফুটপাথে বা বস্তিতে হামেশাই নাবালিকার বিয়ে হয়। অনেকের আট-ন’টা সন্তান হয়। মা, শিশু উভয়েই অপুষ্টি ও রক্তাল্পতায় ভোগে। সংগঠনগুলোর অভিযোগ: হাসপাতালে প্রসব না-হলে মা ও শিশুর কী কী ক্ষতি হতে পারে, সে সম্পর্কে শহরেও যথেষ্ট প্রচার নেই। স্বাস্থ্য-কর্তারাও মেনে নিচ্ছেন, স্বেচ্ছাসেবীরা বিচ্ছিন্ন ভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কাউন্সেলিং, কন্ডোম বিতরণ, বন্ধ্যাকরণ, গর্ভবতীদের পুষ্টি, শারীরিক পরীক্ষা বা টিকাকরণ চালালেও প্রয়োজনের তুলনায় তা দু’শতাংশও নয়!
কিন্তু জননী সুরক্ষা যোজনার মতো প্রকল্প চালু থাকা সত্ত্বেও শহুরে দরিদ্র মহিলাদের একটা বড় অংশ কেন বাড়িতে প্রসব করছেন?
|