হুগলির বেলুমিল্কিতে কৃষিজীবীরাই গড়ে তুললেন শ্রমজীবী হাসপাতাল। বেলুড়ের শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্পের প্রস্তাবিত পাঁচশো শয্যার সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল প্রথম পর্যায়ে তৈরি। আপাতত সেখানে ১২০টি শয্যা রয়েছে। আগামী কাল, ২৬ জানুয়ারি শ্রমজীবীরাই এই হাসপাতালটির উদ্বোধন করবেন বলে শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্প সূত্রে জানা গিয়েছে।
পাঁচতলা এই হাসপাতাল তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল গত বছর মে মাসে। কোনও ঠিকাদার নয়, সুন্দরবন থেকে শুরু করে রাজ্যের বিভিন্ন জেলার চাষি, নিমাণকর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে হুগলির বড়বেলু, ছোটবেলু, বড়া, ঝাঁকাই এবং বেলুমিল্কির চাষি, ভাগচাষি, গরু-ছাগল পালন করেন এমন প্রায় দেড়শো মানুষ হাসপাতাল ভবনটি গড়ে তুলেছেন বলে জানালেন শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্পের কর্মী গৌতম সরকার। বড়বেলু গ্রামের ভাগচাষি খাণ্ডু বাগ কাজের ফাঁকে বললেন, “কেউ আমায় ডাকেনি। এখানে হাসপাতাল তৈরি হবে শুনলাম, তাই নিজে থেকেই লেগে পড়লাম। আমাদের গ্রামে এত বড় হাসপাতাল হবে, স্বপ্নেও ভাবিনি।”
স্থানীয় বাসিন্দারাই জানালেন, প্রথমে কেউ কেউ বলেছিল এরা আসলে জমি-বাড়ির কারবার করতে এসেছে। কিন্তু সব দেখেশুনে এগিয়ে আসেন ওই গ্রামের বাসিন্দারা। পরে আশপাশের মানুষজনও হাসপাতাল তৈরিতে হাত লাগান। স্থানীয় বাসিন্দা তপন খান বললেন, “বেলুড়ের হাসপাতাল দেখে এসেছি। এঁদের সঙ্গে কাজ করে আরও বেশি করে বুঝেছি, এঁরা কী করতে চাইছেন। আমরা গরিব। অসুস্থ হলে ছুটতে হয় শ্রীরামপুরে। সেখানেও সব কিছুর চিকিৎসা হয় না। তখন কলকাতা যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। সেখানেও সরকারি হাসপাতালে জায়গা পাওয়া ভাগ্যের কথা।” |
হাসপাতাল তৈরির কাজ প্রায় শেষ। —নিজস্ব চিত্র |
বেলুড়ের যে হাসপাতাল রয়েছে, সেটাও ছোট। তাই সেখানে সবার পক্ষে চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই ফিরে যেতে হত অনেককেই। এই পরিস্থিতিতে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই শ্রমজীবী হাসপাতালকে বড়সড় করে তোলার চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল বলে জানালেন শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্পের কার্যকরী সভাপতি ফণীগোপাল ভট্টাচার্য। যে ভাবনার জেরে ফণীবাবুরা সিদ্ধান্ত নেন, কলকাতার কাছাকাছি কোনও গ্রামে একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল তৈরি করতে হবে এবং সেখানে থাকবে সব বিভাগের চিকিৎসার ব্যবস্থা। বছর তিন-চারেকের চেষ্টায় অবশেষে কলকাতা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে হুগলির শ্রীরামপুরের কাছে বেলুমিল্কি গ্রামে স্বল্প মূল্যে ৭৫ বিঘা জমি পাওয়া যায়। সেখানেই এই হাসপাতাল তৈরি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়
হাসপাতাল নির্মাণে ব্যস্ত মানুষগুলোর জন্য সিঙ্গুর, তারকেশ্বরের চাষিরা নিয়মিত শাকসব্জি পাঠিয়ে দেন বলে তপনবাবু জানালেন। তাঁর মা, স্ত্রী, মেয়ে এবং গ্রামেরই অন্য কয়েক জন মহিলা এই শ্রমজীবীদের জন্য রোজ তিন বেলা রান্না করে দেন। হাসপাতাল থেকে ৬ কিলোমিটার দূরের বড়া গ্রাম থেকে নিয়ম করে সকালে-বিকেলে এসে কাজকর্মের তদারকি করেন ৭৮ বছরের ‘যুবক’ অমিয় মুখোপাধ্যায়। কাজ করতেন ডিভিসি-তে। একটি হাত জন্ম থেকেই অকেজো। এক হাতেই স্কুটার চালিয়ে যাতায়াত করেন। অমিয়বাবু বললেন, “তদারকির জন্য বেলুড় থেকে ফণীবাবুরা রোজই এখানে আসেন। কিন্তু স্থানীয় কারও সেখানে থাকা দরকার বলে মনে হল। তাই দেখভালের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছি নিজেই।”
প্রথম পর্যায়ে যে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়েছে, কার্যত তার সবটাই এসেছে সাধারণ মানুষের দান থেকে। ফণীবাবুদের বিশ্বাস, বাকি পর্যায়ের কাজগুলির টাকাও সাধারণ মানুষই দেবেন। তাঁর কথায়, “আমরা আশাবাদী। কোনও রকম সরকারি কিংবা বিদেশি অনুদান ছাড়াই সাধারণ মানুষের দানে আমাদের কাজ করার যে ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে, এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।” |