ইট-মাটির নড়বড়ে দেওয়াল। খড়-টালির ছাউনিতে দারিদ্র্য ঢাকা পড়ার নয়। এমন গরিবের ঘরে শহরের হোমরাচোমরা সব নেতারা আসছেন শুনে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন রমিশা। স্বামীকে হারিয়েছেন সদ্য। চোখের জল শুকোয়নি এখনও। প্রদেশ কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য যখন লোকজন নিয়ে ঢুকলেন তাঁর সেই একচিলতে খুপরি ঘরে, সদ্য বিধবা তরুণী ভেবেই আকুল, কোথায় বসাবেন তাঁদের। খোঁজ খোঁজ...। কে যেন কোত্থেকে একটা চেয়ার জোগাড় করে আনল। সেখানেই বসলেন প্রদীপবাবু। চাটাই পেতে সামনে রমিশা আর তাঁর বছর তেরোর মেয়ে মেরিনা।
২১ জানুয়ারি বিকেলে কীটনাশক খেয়ে আত্মঘাতী হন হাওড়ার শ্যামপুরের বালিকুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা বছর উনত্রিশের যুবক শেখ মোস্তাফা। মঙ্গলবার বিকেল ৪টে নাগাদ তারই বাড়িতে এসেছিলেন প্রদীপবাবু। জানালেন, প্রদেশ কংগ্রেস সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রাজ্যে যে সব কৃষক আত্মঘাতী হচ্ছেন, দলগত ভাবে তার কারণ খতিয়ে দেখা হবে। শ্যামপুর থেকে সেই কাজই শুরু হল।
এ দিন মোস্তাফার স্ত্রী রমিশার সঙ্গে দীর্ঘ ক্ষণ কথা বলেন প্রবীন কংগ্রেস নেতা। পরে বলেন, “কে কী বলছেন জানি না। ঋণের দায়ে আত্মঘাতী হচ্ছেন প্রকৃত চাষিরাই। আমি নিজের চোখে দেখলাম। নিজের কানে শুনলাম। মোস্তাফা গত মরসুমে তিন বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। কিন্তু দাম কম বলে ধান ঝাড়তে পর্যন্ত পারেননি।”
সাম্প্রতিক সময়ে মোস্তাফা-সহ রাজ্যে যে সব চাষি আত্মঘাতী হয়েছেন, রাজ্য সরকারের কাছে তাঁদের ‘ক্ষতিপূরণ’ দাবি করেন প্রদেশ সভাপতি। |
হাওড়ার বাঁকড়ায় দর্জির কাজ করতেন মোস্তাফা। সেই সঙ্গে নিজের জমি ও ভাগচাষ মিলিয়ে বিঘে তিনেক জমিতে চাষও করতেন। তাঁর তিন ছেলেমেয়ের মৃত্যু হয়েছে রোগে ভুগে। আর একটি মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। চূড়ান্ত অনটনের সংসার। রমিশার সঙ্গে কথা বলে প্রদীপবাবু জানতে পারেন, বিপিএল তালিকায় নাম ছিল না এই পরিবারটির। প্রদীপবাবু বলেন, “কেন্দ্র ও রাজ্যের বহু প্রকল্প আছে। তা সত্ত্বেও এই পরিবারটি কেন কোনও সাহায্য পেল না, তা তদন্ত করে দেখা হোক।” রাজ্য অবিলম্বে ‘এগিয়ে না এলে’ এ ধরনের মৃত্যু ঠেকানো যাবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
রমিশা প্রদীপবাবুকে জানান, গত মরসুমে বিঘে তিনেক জমিতে আমন ধান চাষ করেছিলেন স্বামী। কিন্তু বেশির ভাগই হেজে (নষ্ট) যায়। ওই চাষের জন্য ১০ হাজার টাকা ধার ছিল বাজারে। কিন্তু এই ধান কী আর বিক্রি হবে!” সদ্য বিধবা তরুণী কংগ্রেস নেতাকে জানিয়েছেন, তিন ছেলেমেয়ে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ছিল। তাদের চিকিৎসায় বহু টাকা বেরিয়ে গিয়েছে। তবে বাঁচানো যায়নি কাউকেই। এলাকার ক্ষুদ্র ঋণদানকারী সংস্থা এবং প্রতিবেশীদের থেকে প্রায় হাজার ৪০ টাকা ধার ছিল মোস্তাফার। রমিশা বলেন, “এ বার বোরো চাষ করতে চেয়েছিল। কিন্তু ট্র্যাক্টরের ভাড়া, মজুরদের টাকা জোগাড় করতে পারেনি। সে জন্য আমার কাছে গয়না চেয়েছিল। কিন্তু আগেও গয়না বন্ধক রেখে ফেরত করতে পারেনি। তাই এ বার আর দিতে চাইনি। একমাত্র মেয়েটার ভবিষ্যতও তো ভাবতে হবে।” বিডিও অফিস পঞ্চায়েত, কোথাও কোনও সাহায্য মেলেনি বলে অভিযোগ করেছেন রমিশা। মোস্তাফার মা মাসুদা বিবি বলেন, “অনেক টাকা দেনা ছিল। সপ্তাহে ৫০০ টাকা কিস্তি মেটাতে হত। এ বার ছেলেটা চাষের খরচও জোগাড় করতে পারেনি।”
প্রদীপবাবু রমিশাকে বলেন, “বউমা, তোমার কোনও চিন্তা নেই। আমরা পাশে আছি।” স্থানীয় কংগ্রেস নেতা আতিয়ার খানকে প্রদীপবাবু নির্দেশ দেন, রমিশার নামে অবিলম্বে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করতে। আমতার কংগ্রেস বিধায়ক অসিত মিত্রকে দায়িত্ব দেন, ওই অ্যাকাউন্টে যেন কিছু টাকা ফেলা হয়। যে জমি চাষের জন্য স্ত্রীর গয়না বন্ধক রাখতে চেয়েছিলেন মোস্তাফা, সেই জমি চাষের ক্ষেত্রেও কংগ্রেস দলীয় ভাবে সাহায্য করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন প্রদেশ সভাপতি। মেরিনার পড়ার দায়দায়িত্বও নেওয়ার কথা বলেন তিনি।
মোস্তাফার মৃত্যুর প্রতিবাদে এ দিন বামপন্থী কৃষক সমিতিগুলির পক্ষে ওই গ্রামে একটি সভা করা হয়। আত্মঘাতী যুবককে ‘চাষি’ বলে দাবি করে ‘ক্ষতিপূরণ’ চাওয়া হয় রাজ্যের কাছে। সিপিএমের জেলা সম্পাদক বিপ্লব মজুমদার বলেন, “চাষ করতে গিয়ে ঋণের জালে জড়িয়েই উনি (মোস্তাফা) আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। ওঁর পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে।”
অন্য দিকে, তৃণমূলের হাওড়া জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের কৃষি বিপনণ মন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, “মোস্তাফা চাষি ছিলেন না। দর্জির কাজ করতেন। অল্প কিছু জমিতে চাষ করেছিলেন। কিন্তু ছেলেমেয়ের চিকিৎসার জন্য দেনা হয়। এর সঙ্গে চাষের কোনও সম্পর্ক নেই। কংগ্রেস এবং সিপিএম এই ঘটনাকে নিয়ে নিম্নমানের রাজনীতি করছে।”
স্থানীয় বাছরি পঞ্চায়েতের প্রধান তৃণমূলের শ্যামসুন্দর মেটিয়াও বলেন, “কংগ্রেস-সিপিএম অযথা রাজনীতি করছে। মোস্তাফা চাষি ছিলেন না। দর্জির কাজ করতেন। ওই পরিবারটি কখনও সাহায্যের জন্যও আসেনি।” পঞ্চায়েতের বিভিন্ন এলাকায় নূন্যতম সহায়ক মূল্যে ধান কেনার কাজ চলছে বলেও দাবি করেছেন তিনি। |