প্রবন্ধ ২...
সুশোভনবাবু থেকে হবসবম,
কেউ তো তবে শিক্ষক হতে পারতেন না

অক্সফোর্ড, ১৯৫৩।
বেলিয়ল কলেজের প্রবেশপথে ঢাউস ট্রাঙ্ক নিয়ে দাঁড়িয়ে এক বঙ্গসন্তান। ভারতে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য নিয়ে লেখাপড়া করতে এসেছে সে। মা-বাবা পোশাকআসাক এমন ঠেসে দিয়েছেন যে, ভারী ট্রাঙ্ক তুলতে সে গলদঘর্ম। গেটেই দাঁড়িয়ে থাকল সে।
আর তখনই টুইড জ্যাকেট গায়ে এক ব্রিটিশসন্তানের আগমন। তার সাহায্যেই ট্রাঙ্কটি ঘরে ঢোকায় বঙ্গপুঙ্গব। ব্রিটিশ কুলিটিকে তার কত দেওয়া উচিত? এক ক্রাউন? না আর একটু বেশি? নানা কিছু ভেবে ছেলেটি কুলিকে তার পারিশ্রমিক আর দেয় না। পরে দেখা গেল, ছেলেটি এই বঙ্গসন্তানের পাশের ঘরেই থাকে। ইতিহাসের ডাকসাইটে গবেষক ক্রিস্টোফার হিল। কয়েক সপ্তাহ পরে বাঙালি ছেলেটি গল্পে গল্পে সে দিনের কথা তোলে। ক্রিস্টোফার হিল হেসে ফেলেন, “দিতেই পারতে। তখন আমার অবস্থা খারাপ যাচ্ছিল। যা দিতে, নিয়ে নিতাম।”
অক্সফোর্ড, ১৯৯৩। এই সপ্তাহেই শিক্ষকতার চাকরি থেকে অবসর নেবেন সেই বঙ্গসন্তান। এত দিনে তিনি ‘প্রফেসর অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি অ্যান্ড সিভিলাইজেশন’। শেষ সপ্তাহের টিউটোরিয়ালে এক ছাত্রীর পড়তে আসার কথা। আচমকা ফোন, ‘যদি দিন কয়েক পরে আসি?’ শিক্ষক রাজি। দিন কয়েক পরে মেয়েটি এসে জানায়, আগের দিন সে ধর্ষিতা হয়েছিল। তারই এক সহপাঠী রাতের বেলা কফি খাওয়াতে ঘরে ডেকে তার ওপরে বলাৎকার করে।
দুটি ঘটনাই ইতিহাসবিদ তপন রায়চোধুরীর সদ্য প্রকাশিত স্মৃতিকথা ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন আওয়ার টাইম’ থেকে। অক্সফোর্ডের শিক্ষাদুনিয়াকে এ ভাবেই বদলে যেতে দেখেছেন তিনি। তপনবাবু এর আগে ‘বাঙালনামা’ নামে একটি স্মৃতিকথা লিখেছিলেন, সেখানে ওই দুটি ঘটনা ছিল না। “বাংলাটা স্ফূর্তিতেই লিখেছিলাম। কিন্তু আমার ছাত্রছাত্রীরা অনেকে ইংরেজিভাষী। তাদের জন্য অন্য ভাবে লিখতে হল,” বলছিলেন লেখক।
বাঙালনামা বেরিয়েছিল ২০০৭ সালে, তার পর পাঁচ বছরের মধ্যে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন আওয়ার টাইম’। অশোক মিত্র বাংলা বইটির সমালোচনায় লিখেছিলেন, ‘এর নাম হওয়া উচিত ছিল দুনিয়ানামা’। সেটাই অক্সফোর্ডবাসী পণ্ডিতকে প্রভাবিত করল? “একেবারেই না। আমি ইতিহাসের লোক, ‘বাবরনামা’, ‘জাহাঙ্গিরনামা’ জানি। কিন্তু দুনিয়ানামা মানে কী? অশোকবাবুও দুনিয়া ঘুরেছেন, তাতে তাঁর বাঙালিয়ানা ক্ষুণ্ণ হয়েছে? সে রকম আমি যেখানেই যাই না কেন, আসলে বরিশালের বাঙাল,” হাসছিলেন তপনবাবু। এই ইংরেজি আত্মজীবনী আসলে বাঙালির একটা সময়ের মানসিক ইতিহাস। সাত-আট বছর বয়সে তপনবাবুর একটি খাতা ছিল। ‘আত্মপরীক্ষার খাতা’। সেখানে রাগ, আলস্য, অবাধ্যতা, পাঠে অমনোযোগ, দেরি করে শয্যাত্যাগ ইত্যাদি ফিরিস্তি। মাস্টারমশায় রোজ সেই খাতা পরীক্ষা করতেন। মনে পড়ে নীরদচন্দ্র চৌধুরীর আত্মজীবনী। তপনবাবুর থেকে ২৯ বছরের বড়, তাঁর জন্ম ১৮৯৭। তাঁদের ছেলেবেলায় ওই রকম খাতা ছিল। তাঁর দাদার খাতায় ‘রূপমোহ’র ঘরে দশ-বারো দিন টিকচিহ্ন দেখে মা রেগে আগুন। দশ-বারো বছরের ছেলের অত রূপমোহ তাঁর সহ্য হয়নি, আচ্ছা করে কান মুলে দিয়েছিলেন।
আরও একটি জায়গা। ছেলেবেলায় তপনবাবুদের বাড়ির বুকশেল্ফ। সংস্কৃত বইয়ের পাশাপাশি শোভা পান মিল, বেন্থাম, হিউম। রয়েছে ফরাসি ভাষায় অগুস্ত কোঁত। দেওয়ালে ওঁর পূর্বপুরুষদের পোর্ট্রেট এবং কিছু বিদেশি ছবির সাদা-কালো প্রিন্ট। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ এরিক হব্সবম লিখেছিলেন, “আত্মজীবনী লেখা ইতিহাসবিদের কাজেরই অংশ।” তপনবাবু বাঙালি মননে ইউরোপীয় আলোকপ্রাপ্তি নিয়ে নানা লেখা লিখেছেন। এই নতুন আত্মজীবনীও যেন সেই কাজেরই সম্প্রসারিত অংশ।
এই বইয়ের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, বিদেশে ভারতীয় ইতিহাসের নির্মাণ। তপনবাবুর অন্যতম কৃতিত্ব, অক্সফোর্ডে ভারতীয় ইতিহাসের ‘সিলেবাস’টি আমূল বদলে দেওয়া। তাঁর আগে অক্সফোর্ডে ভারতীয় ইতিহাস বলতে শুধু ওয়ারেন হেস্টিংস! তাঁর চেষ্টাতেই গাঁধী, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নিয়ে নতুন পাঠ্যসূচি। সেই আধুনিক পাঠক্রমের উদ্গাতা নতুন আত্মজীবনীতে দেখিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারত নিয়ে পড়াশোনা মানে ‘প্রশান্ত মহাসাগরীয় ইতিহাস’। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড এবং ফ্রান্সের সরবোন দুই বিশ্ববিদ্যালয়েই ভারতীয় ইতিহাস মানে ‘ফার ইস্টার্ন স্টাডিজ’। জাপান, ইন্দোনেশিয়া, বোর্নিও, ভারত সব এক। এমনকী মিশর মানে ‘ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ’, আরব-ইতিহাস নয়। “বাঙালনামা লিখতে গিয়ে ঝোঁকটা ছিল ব্যক্তির ওপর। এখানে পৃথিবীর ওপর। তাই এতটা পার্থক্য,” বলছেন ইতিহাসবিদ।
হবস্বম বলেন, সব মানুষের জীবনে একটা ‘চূড়ান্ত মুহূর্ত’ থাকে। তাঁর কাছে যেমন চূড়ান্ত মুহূর্ত, ১৯৩৩ সাল। স্কুল থেকে ফেরার পথে জানলেন, হিটলার ক্ষমতায়। ‘সে দিনই জানতাম, আমি সারা জীবন কমিউনিস্ট থাকব,’ লিখেছিলেন তিনি। দুটি আত্মজীবনী লেখার পর নিজের জীবনের ‘চূড়ান্ত মুহূর্ত’ হিসাবে কোনটা বেছে নেবেন তপনবাবু? “একটা নয়, তিনটে মুহূর্ত। প্রথমটা যে দিন স্যার যদুনাথ সরকারের গবেষণায় সহায়তার সুযোগ পেলাম। দ্বিতীয়টি প্রেসিডেন্সি কলেজে সুশোভনবাবুর (সরকার) ক্লাস করা। তিন নম্বর, আমার নাতনির জন্ম।” ব্যক্তিজীবন, ইতিহাস এবং সাহিত্য এ ভাবেই তাঁর কাছে মিলেমিশে একাকার। যদুনাথের প্রভাবেই কি তাঁর লেখাতেও সাহিত্যিক প্রসাদগুণ? “বলতে পারেন। স্যার যদুনাথ নিজের লেখাকে সাহিত্য হিসাবেই দেখতেন। ‘ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অব মুঘল এম্পায়ার’-এর শেষ খণ্ডের প্রুফ দেখা হয়ে গিয়েছে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, এর পরে কী করবেন? উনি বললেন, আর সাহিত্যকাজের দায়িত্ব নেব না।”
তাঁর ছাত্রাবস্থার প্রেসিডেন্সি কলেজ আজ বিশ্ববিদ্যালয়। ‘সেন্টার অব এক্সেলেন্স’-এর স্বীকৃতিও দিতে চলেছে রাজ্য সরকার। তাঁর কী মনে হয়? “দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্স-এর তখন বেজায় নামডাক। সে সময় পুণ্যশ্লোক রায় একটা ব্যাপারে প্রায়ই সতর্ক করতেন। শিক্ষার সামগ্রিক মান উন্নত না হলে এ দেশে কোনও ‘সেন্টার অব এক্সেলেন্স বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো টিকে থাকতে পারবে না।” প্রেসিডেন্সির হৃতগৌরব? “প্রেসিডেন্সি কলেজের খ্যাতি ছিল শিক্ষকদের জন্য। সব শিক্ষক অবশ্য সমান ছিলেন না। ইতিহাস বিভাগে চার জনের মধ্যে সুশোভনবাবু এবং আর এক জন ক্লাস নিতেন।”
আর, রাজ্যের নতুন শিক্ষা-আইন? তপনবাবুর আত্মজীবনীতে একটি ঘটনা আছে। পশ্চিমবঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে রাজ্যপাল ধরমবীরের নেতৃত্বে রাষ্ট্রপতির শাসন। সেই ঘটনার বিরুদ্ধে দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্স-এ নিন্দাপ্রস্তাব আনলেন তিন শিক্ষক। অমর্ত্য সেন, সুখময় চক্রবর্তী এবং তপন রায়চৌধুরী। নতুন আইনে যে বলা হচ্ছে, শিক্ষকেরা রাজনীতি করতে পারবেন না? হেসে ফেললেন তপনবাবু, “তা হলে সুশোভন সরকার থেকে হব্সব্ম, ক্রিস্টোফার হিল, কেউই শিক্ষক হতে পারবেন না। এ রকম থাকলে সেটাই তো রাজনীতি!”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.