প্রবন্ধ ১...
যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি
নতুন বিমানবন্দরে কি একটাও
বাংলা অক্ষর দেখা যাবে?

মানুষটি এমনই সুপুরুষ, গৌরবর্ণ, সুগঠিত শরীর, মাথাভর্তি সোনালি চুল, স্বপ্নময় চক্ষু দুটি মাঝে মাঝে ঝকমক করে ওঠে, এই মানুষটিকে অপ্সরারা যখন তখন ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত, তাঁর স্ত্রী হেমবতীর পাহারাদারিতেই সেটা সম্ভব হয়নি।
কে ওই রূপবান পুরুষ?
নাম বললে অধিকাংশ বাঙালিই চিনতে পারবেন না। কিংবা বলা যায়, খুব অল্পসংখ্যক বাঙালি যাঁরা সাহিত্য নিয়ে গবেষণা-টবেষনা করেন, তাঁরা চিনবেন। এঁর নাম কুয়েমপু, কর্নাটকের এক অত্যন্ত বিখ্যাত কবি। গড়পড়তা বাঙালি পাঠক এঁকে চিনবেন কী করে, তাঁরা তো ভারতের অন্যান্য ভাষায় কী লেখা হচ্ছে, তা জানতেও চান না। অনুবাদে তাঁরা ফরাসি, জার্মান, রুশ সাহিত্য পাঠ করেন। কিন্তু কোনও আগ্রহ নেই অন্যান্য ভারতীয় ভাষার সাহিত্যে।
না না, আমি পাঠকদের মোটেই বকাবকি করার জন্য এ লেখা শুরু করিনি। বাঙালি পাঠকদের যে মরাঠি, গুজরাতি বা তামিল সাহিত্য পড়তেই হবে, এ রকম মাথার দিব্যি কে দিয়েছে! পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই নির্বাচন করার ব্যাপারে প্রত্যেক পাঠকই স্বাধীন। তাঁরা উচ্চাঙ্গ সাহিত্য কিংবা বাজার-চলতি কুসাহিত্য, যা খুশি পড়তে পারেন। তা ছাড়া, অতগুলি ভারতীয় ভাষার কোন কোনটা তাঁরা পড়বেন? না, সম্ভব নয়। তবে, হঠাৎ অন্য ভাষার এক জন বড় কবি সম্পর্কে কিছুটা জেনে ফেললেও ক্ষতি নেই।
কুয়েমপু ছদ্মনামেই লিখেছেন। ইংরেজি বানানে Kuvempu, তবে তাঁর ভক্তদের মুখে শুনেছি, মাঝখানের ভি উচ্চারিত হয় না। ইনি কর্নাটকে কন্নড় ভাষায় এক জন মহাকবি হিসাবে গণ্য। যদিও ওই ভাষায় আরও অনেক বড়
বড় কবি আছেন। তবু কুয়েমপুর প্রসঙ্গ তোলার উপলক্ষ এই যে, বাংলার সঙ্গে তাঁর বেশ সম্পর্ক ছিল।
প্রথম কথা, ইনি আগাগোড়া রবীন্দ্রভক্ত। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে, তিনি রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করেন। শান্তিনিকেতনের আদর্শে তিনি তাঁর গ্রামের বসতবাড়িটাও একটা আশ্রমের মতন করে বানিয়ে ফেলেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই কবির প্রধান অমিল, রবীন্দ্রনাথ যেমন বিশ্বের বহু দেশে ঘুরেছেন অক্লান্ত ভাবে, কর্নাটকের এই কবি একেবারেই ভ্রমণবিলাসী ছিলেন না। বরং ঘরকুনোই বলা যায়। লেখাপড়া শিখেছেন মহীশূর কলেজে। তার পর সেই কলেজেই চাকরি। ক্রমশ বিভাগীয় প্রধান এবং শেষ পর্যন্ত উপাচার্য। বাড়ি আর কলেজ, এইটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাঁর জীবন। কর্নাটকই তাঁর স্বর্গ। বন্ধুবান্ধবরা ঠেলেঠুলেও তাঁকে বাইরে পাঠাতে পারেন না। তিনি যে বার জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেলেন, সে বারও দিল্লি যেতে চাননি। তবে ১৯২৯ সালে কুয়েমপু কলকাতায় আসেন স্বামী সিদ্ধেশ্বরানন্দের অনুগামী হয়ে।
সে বারে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ-পরিচয় হয়েছিল কি না, তার কোনও বিবরণ পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ তখন দেশে ছিলেন কি না, তাই বা কে জানে। কুয়েমপু অবশ্য এসেছিলেন অন্য একটি উদ্দেশ্যে। তিনি বেলুড় এবং দক্ষিণেশ্বরে যান এবং তখনকার রামকৃষ্ণ মিশনের সভাপতি স্বামী শিবানন্দের কাছে দীক্ষা নেন। রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল আজীবন।
তিনি পুরস্কার এবং সম্মান পেয়েছেন অজস্র। তার মধ্যে আছে জ্ঞানপীঠ ও ভারতরত্ন। তিনি লিখেছেনও প্রচুর। কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, অনুবাদ, শিশু সাহিত্য এবং দুটি জীবনীগ্রন্থ: স্বামী বিবেকানন্দ ও শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা: ‘রামায়ণ দর্শন’। সেই বিপুলাকার গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে বটে, কিন্তু আমার তা পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। তবে, ওই বইটি সম্পর্কে আলোচনায় একটা মজার ঘটনা জানলাম। সীতার অগ্নিপরীক্ষার মতন তিনি রামকেও অগ্নিপরীক্ষা করিয়েছেন।
এক জন লেখক সম্পর্কে শুধু আলোচনা পড়ে ফেলা ঠিক নয়, তাঁর রচনার কিঞ্চিৎ স্বাদও পাওয়া উচিত। তাঁর বহু লেখাই ইংরেজিতে অনূদিত। আমি এয়ারপোর্টে বসে তাঁর একটি ছোট কবিতার দ্রুত অনুবাদ করে দিচ্ছি:

একটি রাস্তা খুব সাধারণ
যখন সন্ধে এসে আকাশকে রঙে ছেয়ে দেয়
(মরুভূমি যেমন উপহার দেয় মরূদ্যান)
দেখুন এই সাধারণ রাস্তাটাকে
সোজা চলে যাচ্ছে স্বর্গের দিকে।
অন্য সময় এই রাস্তাটা
নোংরা, ছাইভস্মে ঢাকা
দুদিকেই সারি সারি টেলিগ্রাফের পোল
যেন একটা কুৎসিত মুখে গর্বের চিহ্ন।
কয়েকটা ইতস্তত বাড়ি, অতি সাধারণ
কোথাও কোনও সুন্দরের চিহ্ন নেই
রাস্তাটা উঁচু হয়ে গেছে পশ্চিম দিকে
তাও পরিকল্পনাহীন, এলোমেলো
কিন্তু যেই সন্ধে নেমে আসে
(একটা বেড়াল হয়ে যায় বাঘ)
দেখো, দেখো, এই অতি সাধারণ রাস্তাটা
চলে যাচ্ছে স্বর্গের দিকে।
কর্নাটকের মানুষ তাদের ভাষাকে খুব ভালবাসে। রাজ্য পরিচালনার অনেক ক্ষেত্রে কন্নড় ভাষার প্রয়োগ হয়। বেঙ্গালুরুর অতি আধুনিক, অতি সুদৃশ্য বিমানবন্দরে বসে কফি খেতে খেতে দেখতে পাচ্ছি, সমস্ত লিখিত নির্দেশিকাতেই ইংরেজি হিন্দির সঙ্গে কন্নড় ভাষাও স্থান করে নিয়েছে।
বাইরে অলস ভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি লাগল। আমাদের কলকাতায় তো খুব শিগগিরই সম্পূর্ণ আধুনিক এবং বেশ বড় আকারের বিমানবন্দরের উদ্বোধন হবে। সেখানে কি একটাও বাংলা অক্ষর থাকবে?
সন্দেহ হচ্ছে কেন? মনে কেন কুডাক ডাকছে!
কাউকে তো দাবি জানাতে হবে। সবাই যেন কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে বাংলা ভাষার অপব্যবহার দেখি, কেউ কোনও প্রতিবাদ করে না। তাই আমি আবার এই প্রশ্ন তুলছি:
কলকাতার নতুন বিমানবন্দরে কি একটাও বাংলা অক্ষর দেখা যাবে?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.