ছয় দশক পর মিশরে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়া পার্লামেন্ট গঠিত হইয়াছে। তীব্র গণ-আন্দোলনে প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের অপসারণের পর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইয়াছে ক্ষমতাসীন সামরিক পরিষদের তত্ত্বাবধানে। মুবারকের বিদায় যদি গণতন্ত্রের পথে প্রথম পদক্ষেপ হয়, তবে প্রতিনিধিত্বমূলক পার্লামেন্ট সেই পথে দ্বিতীয় মাইলফলক। এই পার্লামেন্ট হইতেই সংবিধান-প্রণেতারা নির্বাচিত হইবেন। তাঁহারা দেশের জন্য নূতন সংবিধান রচনা করিবেন। তাহার পর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তত দিন সামরিক পরিষদের হাতেই থাকিবে ক্ষমতার রাশ। এই বন্দোবস্তে অনেক মিশরীয়ের আপত্তি আছে, যেহেতু সামরিক পরিষদের জেনারেলরাই মুবারকের বিশ্বস্ত বাহিনী রূপে এত কাল মিশরীয়দের উপর আধিপত্য করিয়াছেন। কিন্তু বৃহত্তম ও প্রভাবশালী গোষ্ঠী ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ এখনই জেনারেলদের সঙ্গে কোনও সম্মুখ-সমর চাহে না। আর ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক বাহু ‘জাস্টিস অ্যান্ড ফ্রিডম পার্টি’ই যেহেতু নবনির্বাচিত পার্লামেন্টে একক গরিষ্ঠ দল, তাই আপাতত পার্লামেন্টের সহিত পরিষদের সঙ্ঘাতের সম্ভাবনা কম।
মিশরের পার্লামেন্টে প্রায় অর্ধেক আসন দখলকারী জাস্টিস অ্যান্ড ফ্রিডম পার্টির নিয়ামক ব্রাদারহুড ৮৪ বছর ধরিয়া মুসলিম দুনিয়ায় রাজনৈতিক ইসলামকে লালন করিয়াছে। তাহারই সাহায্যে আল হামাস, হেজবুল্লা, পাকিস্তানের জামাতে ইসলামি ও অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠী বিকশিত হইলেও মিশরে ব্রাদারহুডই থাকিয়াছে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনসাধারণের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের একমাত্র শক্তি। মুবারক-উত্তর মিশরেও গোঁড়া সালাফিপন্থী দলের শরিয়তি কল্পরাষ্ট্র বাস্তবায়িত করার প্রকল্পের সহিত ব্রাদারহুড দৃঢ়ভাবে আপন পার্থক্যরেখা রচনা করিয়াছে এবং সৌদি অর্থে পুষ্ট সালাফিপন্থীদের ঠেকাইতে অন্য গণতান্ত্রিক ও সংস্কারবাদী দল ও গোষ্ঠীর সহিত যৌথ ভাবে সরকার গঠন করিবার সিদ্ধান্ত লইয়াছে। মুশকিল হইল, তাহরির স্কোয়ারের গণবিক্ষোভ হইতে উঠিয়া আসা সংস্কারপন্থী গোষ্ঠীগুলি পশ্চিমী গণতন্ত্রের আয়নায় আপনার মুখ দেখিতে চায়। ব্রাদারহুড তাহাদের অনেকের কাছে এতটাই অচ্ছুত যে, তাহার আধিপত্য খর্ব করিতে সালাফিপন্থীদের সহিত জোট বাঁধিতেও তাহাদের আপত্তি নাই। তেমন সম্ভাবনা মূর্ত হইলে মিশর আলজিরিয়ার পথে চলিয়া যাইতে পারে। ইসলামপন্থী ও শরিয়তপন্থীদের আধিপত্য সামরিক পরিষদ শিরোধার্য করিবে না। নির্বাচিত পার্লামেন্টকে নাকচ করিবার বিপদও থাকিয়া যাইবে।
উত্তর আফ্রিকার প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্র টিউনিসিয়াতেও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়া যে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতাসীন হইয়াছেন, তাঁহারাও কিন্তু গোঁড়া শরিয়তি ব্যবস্থা কায়েম করার পথে অগ্রসর হন নাই। আসলে উত্তর আফ্রিকায় মরু ইসলাম সৌদি আরবের মতো কট্টর কখনও ছিল না। লিবিয়া, টিউনিসিয়া, মরক্কো ও আলজিরিয়ার মতো মিশরও ইসলামের উদার ও সহিষ্ণু মধ্যযুগীয় ঐতিহ্যের মধ্যেই স্ফুরিত হইয়াছে। মিশরের রাজধানী কায়রোই ছিল একদা শিয়া ইসলামের প্রাণকেন্দ্র। এ জন্যই মিশরে কপ্টিক খ্রিস্টানরা এখনও দেশের জনসংখ্যার দশ শতাংশ। যে কোনও উপায়ে ক্ষমতালাভের তাগিদ যদি মিশরের পশ্চিম-ঘেঁষা গণতন্ত্রীদের শেষ পর্যন্ত সালাফিদের মতো ধর্মান্ধদের সহিত আপস করিতে প্ররোচিত করে, সেটা হইবে নূতন এক দুঃসময়ের আগমনী। রাজনৈতিক স্বৈরাচারের কবল হইতে বহু কাল বাদে মিশরীয়রা মুক্ত হইয়াছেন। দমন-পীড়ন উপেক্ষা করিয়া গণ-আন্দোলন মারফত তাঁহারা যে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনের উদ্বোধন করিতে সমর্থ হইয়াছেন, খিড়কির দরজা দিয়া তাহাতে মৌলবাদী শক্তি অন্তর্ঘাতের চেষ্টায় আছে। এ ব্যাপারে জনসাধারণের সতর্ক হওয়া দরকার। ব্রাদারহুডের বিরোধিতা করিতে গিয়া প্রায় তালিবানি কট্টরপন্থীদের ডাকিয়া আনিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ওই সুবিধাবাদীদের মার্জনা করিবে কি? |