প্রথমে সিঙ্গুর ও পরে নন্দীগ্রামের কৃষিজীবীদের জমির অধিকার রক্ষার আন্দোলনকে কেন্দ্র করিয়া পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট-বিরোধী জনমত সংগঠিত হয়। পরে সেই জনমতই রাজনৈতিক পরিবর্তনের অনুকূলে সমাবেশিত হইয়া রাজ্য জুড়িয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসকে একক শক্তিতে রাজ্য বিধানসভায় গরিষ্ঠতা অর্জনে সাহায্য করে। যে কৃষকরা সে দিন জমি হারাইবার ভয়ে বামফ্রন্ট হইতে তাঁহাদের সমর্থন প্রত্যাহার করিয়াছিলেন, আজ তাঁহারাই দেখিতেছেন, কৃষি আর তত লাভজনক বৃত্তি নয়। ধান হউক কিংবা আলু, তাঁহাদের উৎপাদিত পণ্যের তেমন বাজারদর নাই। আর সরকার ওই সব কৃষিপণ্যের যে ন্যূনতম সংগ্রহমূল্য বাঁধিয়া দিয়াছে, তাহাও চাষিদের ভাগ্যে জুটিতেছে না। ক্রেতা-সংগঠনের দেওয়া চেক ব্যাংকে ভাঙাইতে গিয়া দেখা যাইতেছে, সংস্থার আমানতে টাকাই নাই। অসহায় কৃষকরা ঋণভারে জর্জরিত হইয়া কিংবা নিছক হতাশা হইতে আত্মঘাতী হইতেছেন।
চাষিদের এই আত্মহত্যা লইয়া আবার সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতি শুরু হইয়া গিয়াছে। চাপান-উতোরে রাজনীতির হাওয়া গরম হইলেও তাহাতে চাষিদের কোনও উপকার হইতেছে না। তাঁহাদের মাঠের ফসল মাঠেই পড়িয়া থাকিতেছে, কারণ হিমঘরে স্থানাভাব, অতি-উৎপাদনের ফলে গত বছরের ফসলও পুরোপুরি বাজারে পৌঁছানো যায় নাই। কৃষি সম্পর্কে শাসকদের চিন্তা-ভাবনা এবং কৃষিবিষয়ক নীতিতে যে-গলদ, রাজ্যের কৃষিজীবীদের তাহারই খেসারত দিতে হইতেছে। কৃষি যে আর আগের মতো লাভজনক নয়, শিল্পের জন্য কৃষিজমি অধিগ্রহণ না করিলে যে রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা কৃষকের জীবনযাত্রার মানও উন্নীত হইবে না, এই সার অর্থনৈতিক সত্যটি রাজনীতিকরা রাজনীতির স্বার্থেই অগ্রাহ্য করিয়াছেন। প্রতিপক্ষ দলকে কোণঠাসা করিবার অত্যুৎসাহে অর্থনীতির মূল সূত্রগুলিই উপেক্ষিত থাকিয়াছে। শিল্পের বিকাশ থমকাইয়া গিয়াছে। অথচ কৃষিতে পুঁজি ও উন্নত প্রযুক্তির লগ্নিও সে-ভাবে ঘটে নাই। কৃষিপণ্যকে বাজারজাত করিবার কোনও সুষ্ঠু ব্যবস্থাও হয় নাই। পুরানো পদ্ধতিতে ফসল ফলাইতে গিয়া কৃষকরা যে ঋণের দায় কাঁধে লইতে বাধ্য, লাভজনক দামে ফসল বিক্রির বন্দোবস্ত না থাকায় তাহা নষ্ট হইতেছে কিংবা লোকসানে বেচিতে হইতেছে। কৃষি-সমবায়, চুক্তি-চাষ কিংবা বিপণন সংস্থার অনুপস্থিতি সমগ্র কৃষক সমাজেই তীব্র হতাশা সৃষ্টি করিতেছে।
দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হইল, কৃষির এই সঙ্কট লইয়া দলীয় রাজনীতির চাপান-উতোর। কৃষিজীবীর আত্মহত্যা নূতন কিছু নহে। বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘ শাসনকালেও কিন্তু রাজ্যের বহু কৃষক আত্মঘাতী হইয়াছেন। তাঁহাদের শাসনপর্বেও সমবায় ভিত্তিতে কৃষি প্রবর্তনের চেষ্টা হয় নাই, চুক্তি-চাষে রাজনৈতিক বাধা দেওয়া হইয়াছে, আন্তর্জাতিক খুচরো বিপণন সংস্থাকে লগ্নি করিতে দেওয়া হয় নাই। আবার যেখানে বামফ্রন্ট কখনও ছিল না, সেই মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ ও কর্নাটকেও বহু কৃষিজীবী আত্মঘাতী হইয়া থাকেন। তাই কেবল যে তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত বর্তমান সরকারের আমলেই কৃষি সঙ্কটাপন্ন, এমন নয়। ইহার জন্য কোনও বিশেষ দলকে দোষারোপ করাও অর্থহীন। বরং সকলে মিলিয়া সমস্যা ও সঙ্কটের সমাধানে গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শ মারফত অগ্রসর হওয়া উচিত। |