সন্ত্রাসের জীবনে বহু মৃত্যুর ভাগীদার হয়েছেন। কিন্তু সেই রাতের কথা বলতে কেঁপে ওঠেন প্রাক্তন জঙ্গিটিও। বললেন, “রাতের অন্ধকারে একটা লোককে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এল জওয়ানরা। হাতে শিকল বাঁধা। সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দিল তাকে। মাঝরাতে একটা শব্দ। সকালে দেখলাম, লোকটির দেহ মেঝেতে পড়ে রয়েছে। হাতের কব্জি কাটা, তাতে তখনও শিকল বাঁধা।”
শুধু প্রাক্তন জঙ্গিই নন, উপত্যকার বাসিন্দাদের এমন নানা আতঙ্কের অভিজ্ঞতা তুলে ধরবে ‘ইনসাল্লাহ কাশ্মীর: লিভিং টেরর’। তবে হল-এ নয়, আগামী ২৬ জানুয়ারি অনলাইনে এই ছবি মুক্তির পরিকল্পনা করেছেন পরিচালক অশ্বিন কুমার। কেন? অস্কারের জন্য মনোনীত ‘লিটল টেররিস্ট’ ছবির পরিচালকের একটাই উত্তর, সেন্সর বোর্ডকে এড়াতে। |
এর আগে কাশ্মীরের এক প্রাক্তন জঙ্গি আর তাঁর ফুটবলার হতে চাওয়া ছেলেকে নিয়ে ‘ইনসাল্লাহ ফুটবল’ নামে একটি ছবি তৈরি করেছিলেন অশ্বিন। সেটা সেন্সর বোর্ড প্রথমে আটকে দিয়েছিল। পরে ছবিটিকে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। দুন স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র তাঁর প্রাক্তন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিয়ে তৈরি করেছিলেন ‘ডেজড ইন দুন’। সেই ছবির মুক্তি আটকে আছে আদালতে। ‘ইনসাল্লাহ কাশ্মীর’-এর ক্ষেত্রে সেন্সর বোর্ডের কাছেই যাননি অশ্বিন। ইউটিউবে ইতিমধ্যেই দেখানো হচ্ছে ছবিটির ট্রেলার। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিষয়বস্তু নিয়ে ভারতে যখন বিতর্ক শুরু হয়েছে, তখন অনলাইনে এই ছবির মুক্তি তাতে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। জম্মু ও কাশ্মীরের আইনমন্ত্রী আলি মহম্মদ সগর বলছেন, “পরিচালকের উচিত
আগে সেন্সর বোর্ডের সঙ্গে কথা বলা। তবে প্রশাসনের তরফে আমরা এখনও কিছু ভাবিনি।”
কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক শেখ শওকত মনে করাচ্ছেন, এই ছবির আর একটি বৈশিষ্ট্য হল, এক জন কাশ্মীরি পণ্ডিত ছবিটি করছেন। অশ্বিন নিজেই কাশ্মীরি। জঙ্গি আক্রমণের জেরে হিন্দু পণ্ডিতরা বহু বছর ধরেই উপত্যকা ছাড়া। সরকার তাঁদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করলেও বিশেষ লাভ হয়নি।
|
পরিচালক অশ্বিন। |
কলকাতায় যাঁর জন্ম এবং প্রাথমিক পড়াশুনো, সেই অশ্বিন অবশ্য এই বিষয়ে মুখ খুলতে চান না। তাঁর কথায়, “উপত্যকার বাসিন্দাদের এই আতঙ্ককে, তাঁদের জীবনের এই অন্ধকার দিকটাকে আমরা সকলেই এড়িয়ে চলতে চাই। ২০০৯ সালে আমি ‘ইনসাল্লাহ ফুটবল’ তৈরি করার জন্য কাশ্মীরের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছিলাম। অনেকের সঙ্গে কথা বলি। তখনই আমার মনে হয়েছিল কাশ্মীরবাসীর এই অভিজ্ঞতার কথা জানার সুযোগ খুব কম পাওয়া যায়। আর তাই তাঁদের মুখেই তাঁদের কথা সকলকে জানাতে চেষ্টা করেছি।” ইউটিউবে ট্রেলার দেখে কোনও কোনও দর্শকেরও প্রতিক্রিয়া “প্রাক্তন জঙ্গিদের বিশ্বাসঘাতক বা পাকিস্তানি বলে ঘৃণা না করে, কাশ্মীরের পরিস্থিতিটা আসলে কী রকম, সেটাই বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে এই তথ্যচিত্রে।”গত বছর পরিচালক ওনিরের ‘আই অ্যাম’ ছবিতেও একটি কাহিনি ছিল কাশ্মীরকে ঘিরে। ‘আই অ্যাম মেঘা’তে উপত্যকা ছাড়তে বাধ্য হওয়া পণ্ডিত পরিবারের মেয়ের চোখ দিয়ে দর্শক দেখেছিল আত্মসমর্পণ করা জঙ্গির হেনস্থা, ফেলে আসা বন্ধুত্ব। কিন্তু সিনেমা হলই যেখানে বন্ধ, সেই কাশ্মীর দেখতে পায়নি ওই ছবি।
অশ্বিনের ছবি ইন্টারনেটে আসাকে স্বাগত জানাচ্ছেন ওনির। বলছেন, “ইন্টারনেটে মুক্তি পেলে অনেক লোকের কাছে পৌঁছে যাবে এই ছবি, যাঁদের অন্য ভাবে তা দেখার উপায় নেই। বিশেষত কাশ্মীরের লোকেরা নিজেদের ছবি দেখতে পাবেন।” আর সেনা-জওয়ানের হাতে কাশ্মীরিদের দুর্দশার ছবি তৈরি করছেন এক কাশ্মীরি পণ্ডিত, তারও একটা বাড়তি তাৎপর্য থাকছে। “যাঁদের চিরাচরিত ভাবে শত্রু ভেবে আসা হয়েছে, তাঁদেরই এক জনের চোখে নিজেদের দেখতে পাওয়ার গুরুত্বই আলাদা,’’ বললেন ওনির। |