‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ নিষিদ্ধ হওয়ার পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীকে খোলা চিঠি লিখেছিলেন সলমন রুশদি। সেটা ১৯৮৮-র অক্টোবরের কথা। প্রায় ২৪ বছর পরে সেই ঘটনার সঙ্গে হালফিলের ‘নিষেধাজ্ঞা’র এক অদ্ভূত মিল পাচ্ছেন লেখক নিজেই। তাঁর কথায়, “ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, যা ভারতের মতো গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত দুঃখজনক!”
জয়পুর সাহিত্য উৎসবে ভিডিও-বৈঠকেও তাঁর প্রবেশ নিষেধ, এটা জেনে যত না দুঃখিত, তার থেকে অনেক বেশি ক্ষুব্ধ ‘বুকার অফ বুকার্স’ জয়ী লেখক। আজ সন্ধ্যায় একটি বেসরকারি নিউজ চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেই
ক্ষোভ উগ্রে দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, “হ্যাঁ, আমি ব্যথিত। কিন্তু এই দুঃখ শুধু ব্যক্তিগত স্তরে সীমাবদ্ধ নয়। আমি হতাশ সেই দেশটার কথা ভেবে, যাকে চিরকাল ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য ভালবেসে, শ্রদ্ধা করে এসেছি। আমি দুঃখিত সারা ভারতের জন্য।”
রুশদির মনে করেন, “এই ভারতবর্ষে ধর্মান্ধতা বাক্ স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে। কিছু রাজনৈতিক নেতারা, নির্বাচনী লাভ-লোকসানের কথা মাথায় রেখে, একই সুরে সুর মেলায়। দেখা যাচ্ছে পুলিশের ক্ষমতাও অত্যন্ত সীমিত।” নিষেধাজ্ঞার কোপে তিনি তো এই প্রথম পড়লেন না! ১৯৮৮ সালের ১৯ অক্টোবর ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ রাজীব গাঁধীকে সেই খোলা চিঠিতে রুশদি প্রশ্ন তুলেছিলেন, “আপনি কোন ভারত শাসন করতে চান? যে দেশে ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রকাশের অবকাশ আছে, নাকি, যেখানে প্রতিপদে দমনমূলক নীতি নেওয়া হয়?” এই ভারতে, রুশদি নিজেই বললেন, “কিন্তু বহু বার এসেছি। গত আট-ন’ বছরে অন্তত পাঁচ-ছ’বার। বছর কয়েক আগে এই জয়পুর সাহিত্য উৎসবেই এসেছিলাম। গত বছর দিল্লিতে এসেছিলাম একটি ইংরেজি পত্রিকার আয়োজিত অনুষ্ঠানে। বছর দু’য়েক আগে স-পরিবার বেড়িয়েছি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কই, তখন তো, কেউ আপত্তি করেনি। আর এখন ভিডিও-র পর্দাতেও আমাকে দেখানো যাবে না!” আরও অনেকের মতো, রুশদি নিজেও এই নিষেধাজ্ঞার পিছনে স্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দেখতে পাচ্ছেন। সামনেই উত্তরপ্রদেশ নির্বাচন। সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখেই যে মিল্লি কাউন্সিল বা জামাত-ই-ইসলামিকে চটানো হচ্ছে না, তা জোর গলায় বলতে রুশদি ইতস্তত করছেন না। “আর কী কারণ হতে পারে, বলুন? সব থেকে হাস্যকর ব্যাপার হল, আমায় ইসলামের শত্রু বলা হচ্ছে। আমিই তো বরাবর বলে এসেছি, ইসলামের আসল শত্রু এই মৌলবিরা, দেওবন্দিরা। দেশের পাঁচটা সাধারণ মুসলিমকে জিজ্ঞাসা করুন। সলমন রুশদি একটা সাহিত্য উৎসবে এলেন কি না, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। তারা তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থার হাল, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত। আমি খুব দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, এ দেশের অধিকাংশ মুসলিমের কাছে আমি একটা ‘নন-ইস্যু’। আমি এলাম, কি গেলাম, তাতে কারও আসে যায় না। আর আমার ধারণা, এমন বেশ কিছু মুসলিম রয়েছেন, যাঁরা আমি কী বলছি, শুনতে যথেষ্ট উৎসুক।”
কাল কেউ এক জন ট্যুইট করেছিলেন, “সরকার যদি মোল্লাদের সামলাতে না পারে, সেটা সরকারের সমস্যা, মুসলিমদের নয়।” রুশদি এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত নন। “এটা ভারতের মুসলিমদের সমস্যা নয়, এ কথাই বা বলি কী করে, বলুন? মুসলিমদেরই তো ঠিক করতে হবে, তাঁরা কাকে তাঁদের নেতা হিসেবে দেখতে চান। এখন যাঁরা মুসলিম নেতা বলে নিজেদের তুলে ধরেছেন, নয় তাঁরা নেতা-ই নন, না হলে খুব খারাপ মানের নেতা। এবং রাজনৈতিক নেতারা যে এই সব তথাকথিত নেতাদের মন যুগিয়ে চলতে চান, সেটাই আরও দুঃখের।”
জয়পুর সাহিত্য উৎসবে তাঁর উপস্থিতি (বা ভিডিও উপস্থিতি) বানচাল করে দেওয়া হয়েছে, এই সব নেতাদের মন যোগাতেই, সোজাসাপ্টা বললেন রুশদি। “প্রথমে ভেবেছিলাম, আমার নিরাপত্তার কথা ভেবে এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। রাজস্থান সরকারের কাছ থেকে সেই মর্মে আমি একাধিক ই-মেলও পেয়েছিলাম। কিন্তু তার পর দেখলাম, সেই সব যুক্তি ধোপে টিকছে না। এমন কী, পুলিশ, রাজস্থান সরকার বা দিল্লিও পরস্পর-বিরোধী মন্তব্য দিতে শুরু করল। মুখে বলা হবে বাক্ স্বাধীনতা, কিন্তু পছন্দসই কথা না বললেই গলা টিপে দেওয়া হবে, এই ভারত আমায় সত্যি ব্যথিত করে। খুব, খুব ব্যথিত।”
|
সলমন রুশদিকে নিয়ে একই দিনে দু-রকম মন্তব্য করলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত। সকালে বললেন, দিল্লিতে এলে তাঁকে স্বাগত জানাবেন। সন্ধ্যায় ঠিক উল্টো সুরে বললেন, রুশদিকে দিল্লিতে অতিথি হিসেবে স্বাগত জানানোর প্রশ্নই ওঠে না। জয়পুর সাহিত্য উৎসবে রুশদি-বিতর্ক চলাকালীনই দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে আসার জন্য গত কাল রুশদিকে খোলা আমন্ত্রণ জানিয়েছে এক সংস্থা। সেই প্রসঙ্গেই আজ সকালে শীলা বলেন, “রুশদির লেখা নিয়ে মতবিরোধ থাকতেই পারে। কিন্তু তাঁর মতো মানুষ যদি দিল্লিতে আসতে চান, তা হলে তাঁকে স্বাগত।” সন্ধ্যায় শীলা বলেন, “রুশদি বিখ্যাত লেখক। বুকার পর্যন্ত পেয়েছেন। কিন্তু এ শহরে ওঁকে অতিথি হিসেবে আপ্যায়নের প্রশ্নই ওঠে না।” |