‘ধর তক্তা’য় নেই সঞ্জয়, তাই জয়পুরের জয়
র পাঁচ জন বাঙালির মতো সঞ্জয় রায়েরও ১৮ মাসে বছর!
দীর্ঘসূত্রিতা নয়, অন্য কারণে।
“একটা উৎসবের ঠিকঠাক পরিকল্পনা করতে দেড় বছর সময় দিতেই হবে। কলকাতায় এ বার যে সাহিত্য উৎসব হচ্ছে, তার উদ্যোক্তারা আমার কাছে এসেছিলেন। তাঁদেরও দুঃখের সঙ্গে ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। ও রকম ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ ঢঙে আমি কাজ করতে পারি না,” বললেন সঞ্জয় রায়। জয়পুর সাহিত্য উৎসবের মূল উদ্যোক্তা ও মস্তিষ্ক এই বাঙালিই।
খুঁটিনাটি পরিকল্পনা ছাড়া কোনও কাজে হাত দেন না সঞ্জয়। সেই ‘পরিকল্পনা’র জোরেই পাঁচ বছরের মধ্যে জয়পুর সাহিত্য উৎসব আজ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বৃহত্তম। উৎসবের শেষ দিনেই তাঁর পকেটে আগামী বছরের অতিথি-তালিকা। অমর্ত্য সেন, ঝুম্পা লাহিড়ি, নোয়াম চমস্কি, মার্গারেট অ্যাটউড, উমবের্তো একো! কেন ১৮ মাস ধরে পরিকল্পনা চলে, পরিষ্কার!
সঞ্জয় রায়
নিজস্ব চিত্র
শিকাগোর ‘আই অন ইন্ডিয়া’, তেল আভিভের ‘সেলিব্রেটিং ইন্ডিয়া’, সিঙ্গাপুরের ‘কলা উৎসবম’, দক্ষিণ আফ্রিকার ‘শেয়ারড হিস্ট্রি...দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’ ১১টি দেশের ২১টি শহরে ছড়িয়ে আছে সঞ্জয় রায়ের ‘টিমওয়র্ক’ সংস্থার উৎসব-সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্যে জয়পুরের ভূমিকা? “অনেকটাই। জয়পুরের আগে আমাদের ১২টা উৎসব ছিল। এখন ১৭টা,” জানালেন ‘থিয়েটার অ্যাকশন গ্রুপ’-এর একদা মুখ্য পরিচালক। ব্যারি জনের ওই দলে আগে অভিনয় করতেন শাহরুখ খান, লিলেট দুবে বা ‘ক্যুইজমাস্টার’ সিদ্ধার্থ
বসু। সঞ্জয়ের নাটক-প্রেমই তো এ বার জয়পুরে নিয়ে এল ‘শেক্সপিয়র ইন লভ’ ছবির চিত্রনাট্যকার টম স্টপার্ড-কে। এলেন গিরিশ কারনাডও! সিনেমাতেও নেমেছে সঞ্জয়ের ‘টিমওয়র্ক’। সন্দীপ রায়ের ‘টিনটোরেটোর যিশু’ ছবির লাইন-প্রোডিউসার ছিল তারা। জন্মশহর কলকাতার সঙ্গে এ ভাবেই রয়ে গিয়েছে সঞ্জয়ের ‘বং কানেকশন’।
কলকাতায় জন্ম হলেও ছেলেবেলাটা মুম্বই, লন্ডন এবং দিল্লিতে কেটেছে। “আপনি যদি শুধু একটা শহরের জানলা দিয়েই পৃথিবীকে দেখেন, মনের মধ্যে শ্যাওলা গজিয়ে যেতে পারে,” বললেন সঞ্জয়। এই শিক্ষাটা মা-বাবার থেকে পাওয়া। বাবা ছিলেন ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি ও পরবর্তী কালে ভারতীয় নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল। মামা প্রাক্তন পুলিশকর্তা রঞ্জিত গুপ্ত। মনের মধ্যে শ্যাওলা জমতে না দিলেও সঞ্জয়ের জীবনে তিনটি নিরুচ্চার বাঙালিয়ানা রয়েছে। একটা যদি হয় নাটক, বাকি দু’টো কলেজ-রাজনীতি আর প্রেম। কলেজে প্রথম বছর ক্লাসেই যেতেন না। প্রিন্সিপালকে ঘেরাও, কাফেতে আড্ডা নানাবিধ গল্প। প্রেমটাও মজাদার। ‘থিয়েটার অ্যাকশন গ্রুপে’ই নাটক করতেন সঞ্জয়ের স্ত্রী পুনিতা। তিনি তখন ‘ওয়েস্টার্ন আউটডোর’ গ্রুপের ম্যানেজার। ওই সংস্থাই আজকের ‘ইউটিভি’-র পূর্বসূরি। বেশ কয়েক মাস পরে ভাবী শ্বশুরের দ্বারস্থ হলেন সঞ্জয়। আর পাঁচ জন মেয়ের বাবার মতো তিনিও জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করো?’ উত্তর এল ‘নাটক’। শ্বশুরমশায় হতবাক, ‘তা হলে খাবে কী?’ প্রেমিকের উত্তর, ‘কেন? আপনার মেয়ে তো চাকরি করে। আমি নাটক-ই করব।’
নাটকের খাতিরেই দূরদর্শনে সিরিয়াল পরিচালনার বহু প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সঞ্জয়। কিন্তু প্রেমের চাপ অন্য বস্তু। আশির দশকের শেষাশেষি বন্ধু মোহিত সত্যানন্দের সঙ্গে তৈরি করলেন ‘টিমওয়র্ক’। স্যাটেলাইট টিভির আদিযুগে জি টিভির ‘তোলমোলকে বোল’ বা স্টার টিভির ‘নিউজলাইন’ ইত্যদি অনেক অনুষ্ঠানই টিমওয়র্কের প্রযোজনা ছিল। অতঃপর ’৯৫ সালে ফের বিরক্তি। “কাঁহাতক টেনে টেনে সিরিয়াল বাড়ানো যায়? একটা মিটিং-এ সিদ্ধান্ত নিলাম, নো মোর টিভি!”
১৯৯৯ সালে লন্ডন যাওয়া। একুশ শতকের শুরুতে এডিনবরা উৎসবের পরিকল্পনা ও বিপণন করল ‘টিমওয়র্ক’। জয়পুরের অভিজাত দম্পতি জন সিংহ ও ফেথ সিংহ সেই উৎসব দেখে মুগ্ধ। দেশে ফিরে ২০০২ সালে ওঁরাই গড়ে তুললেন ‘জয়পুর বিরাসত ফাউন্ডেশন’। সেই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগেই শুরু হল ‘বিরাসত উৎসব’। তারই ছোট্ট অংশ হিসেবে রইল সাহিত্য উৎসব। পরামর্শদাতা উইলিয়াম ডালরিম্পল ও নমিতা গোখলে। কিন্তু কয়েক বছর পর থেকে সেই উৎসব ক্রমে রুগ্ণ হচ্ছিল। তখন দায়িত্ব নিল ‘টিমওয়র্ক’। এডিনবরার ছেলে ডালরিম্পলকে আগেই চিনতেন সঞ্জয়। ‘হোয়াইট মুঘল’ লেখার বহু আগেই বন্ধু তরুণ তেজপালের বাড়িতে ডালরিম্পলের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। সঞ্জয়-ডালরিম্পল এক হতেই তৈরি হল ইতিহাস।
এমনিতে জয়পুর শীতকালে বিদেশি পর্যটকদের প্রিয়। সেখানে ‘প্রাসাদের সাহিত্য উৎসব’ স্বভাবতই এখন মুখ্য আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদেশিদের কাছে। জয়পুরের স্থান-মাহাত্ম্য স্বীকার করছেন সঞ্জয়ও, “উৎসবের সঙ্গে সেখানকার স্থানীয় ঐতিহ্য, লোকাচার মিশে গেলে তার আকর্ষণটাই বেড়ে যায়। জয়পুর ছাড়া অন্য কোনও জায়গায় বোধ হয় সাহিত্য-উৎসব এ ভাবে হিট করত না।” আর ডালরিম্পল? এই সাহিত্য উৎসবের পিছনে তাঁর আবেগ এবং ভবিষ্যদৃষ্টি জানতে কারও বাকি নেই। “ডালরিম্পলের ক্ষমতা সাঙ্ঘাতিক। একই সঙ্গে লেখকদের মুগ্ধ করায় ও তার পর তাদের ক্রমাগত চাপ দেওয়ায় ওর জুড়ি মেলা ভার,” বলছিলেন নমিতা। কাজের ভাগাভাগি কেমন? পাঁচ দিনের অনুষ্ঠানে ‘হার্ডওয়্যার’ সরবরাহ করেন সঞ্জয়। নমিতা ও ডালরিম্পল ‘সফটওয়্যার’... লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ ও প্রোগ্রামিং। ইতিমধ্যে মোহিত তৈরি করেছেন ‘ফ্রেন্ডস অব মিউজিক’। আজকের ‘ইন্ডিয়ান ওশন’-সহ বহু ব্যান্ডের শুরু সেখান থেকেই। জয়পুর সাহিত্য উৎসবেও কোনও সন্ধ্যায় সাবরি ভাইদের কাওয়ালি, কখনও বিশ্বমোহন ভট্টের বীণা বা ‘ডাব কলোসাস’-এর গান। লন্ডনের ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকা তো জয়পুর সাহিত্য উৎসবকে ‘দুনিয়ার সেরা পাঁচটি সঙ্গীত উৎসবের অন্যতম’ বলে ঘোষণাই করে দিয়েছে। “ভাল লাগছে, কিন্তু সাহিত্য উৎসবই প্রধান। ওটা উপরি পাওনা,” বলছেন তিনি।
পাঁচ বছরে উৎসব আড়েবহরে যা বেড়েছে! প্রথম বার ছিলেন ৭০ জন লেখক, মেরেকেটে ৭ হাজার দর্শক। এ বার ২৫৮ জন লেখক, ১ লক্ষ ২৫ হাজার দর্শক। আর পিছনের ভাঁড়ার ঘর? পাঁচ দিনে গড়পড়তা ১০ লক্ষ টাকার বিদ্যুৎ ও জেনারেটর। নিরাপত্তা ও খাওয়াদাওয়া বাবদ ৭০ লক্ষ। পাঁচটি প্যাভিলিয়ন, অতিথিদের জন্য হোটেল ভাড়া ইত্যাদিতে এক কোটি। লেখকদের বিমানভাড়ায় আরও দেড় কোটি। “প্রথম বছর দেড় কোটি টাকা বাজেট ছিল। এ বার হয়েছে পাঁচ কোটি,” বললেন সঞ্জয়। ভাবতে পেরেছিলেন, উৎসব এ ভাবে বাড়বে? “একেবারেই না। বরং এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ছিলেন ডিএসসি-র এইচ এস নারুলা। তিনিই বলেছিলেন, এই উৎসব এক দিন এডিনবরাকে ছাড়িয়ে যাবে।” দিল্লির কনস্ট্রাকশন-সংস্থা ‘ডিএসসি’-ই এই উৎসবের প্রধান স্পনসর। ‘টিমওয়কর্’ এই উৎসব হাতে নেওয়ার পর থেকেই এর নাম ‘ডিএসসি জয়পুর সাহিত্য উৎসব’। তার সঙ্গে ‘টাটা স্টিল’, ‘ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকা’ থেকে ‘কোকাকোলা’, ‘গুগ্ল’, ‘রিও টিন্টো’...কারা নেই?
সঞ্জয় রায়ের বৈশিষ্ট্য এখানেই। উইকিলিক্স-কাণ্ডের জেরে ‘ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকা’র সঙ্গে ‘গুগ্ল’-এর এখন অহি-নকুল সম্পর্ক। কিন্তু সাহিত্য উৎসবে দুই সংস্থাই আছে সমান তালে। মার্কিন সাপ ও বেজিকে মরুভূমিতে একসঙ্গে জল খাওয়ানো কম কৃতিত্বের কথা নয়! লম্বা সাদা চুলের উপর সানগ্লাসটা তুলে দেন সঞ্জয়। চুল কাটেন না কেন? “ছেলের স্কুলে পেরেন্ট-টিচার মিটিং ছিল। ছেলে বলল, চুল কাটতে হবে। বললাম, তা হলে যাবই না। এক দিকে ছেলের স্কুলে যাওয়ার গুরুদায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেলাম। তার পর এডিনবরা-শিকাগোয় দেখলাম, লম্বা চুলের জন্য লোকে বেশ খাতির করছে। ভাবছে আমি কেউকেটা!” ৫০ বছরের সঞ্জয় রায়। বিরল বাঙালি, যিনি অক্লেশে নিজেকে নিয়ে মজা করতে পারেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.