সাত দিন দফায় দফায় আলোচনা চালিয়েও লাভ হল না। শেষ দিন ভিডিও-লিঙ্কেও জয়পুর সাহিত্য উৎসবে আসতে পারলেন না ‘স্যার’ সলমন আহমেদ রুশদি। “আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে। সকাল থেকেই বিভিন্ন সংগঠন জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, ভাঙচুরের হুমকি দিচ্ছে,” বলতে বলতে মঞ্চেই কেঁদে ফেললেন জয়পুর সাহিত্য উৎসবের প্রযোজক সঞ্জয় রায়। তাঁর পাশে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে উইলিয়াম ডালরিম্পল ও নমিতা গোখেল।
বাজ পড়লেও ডিগ্গি প্রাসাদের লনে জমায়েত ভিড়টা এতখানি চমকাত না। মঙ্গলবার সকালেও সাংবাদিক বৈঠক ডেকে সঞ্জয় চূড়ান্ত ঘোষণা করেছিলেন, রাজস্থান সরকার সবুজ সিগন্যাল দিয়েছে। বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিটে লনের পর্দায় দেখা দেবেন রুশদি। স্যাটেলাইট লিঙ্কে তাঁকে প্রশ্ন করা হবে। ফলে বিকেল ৩টে থেকেই ভিড় শুরু। আগের অনুষ্ঠান শেষ হয়নি, সকলেই পৌনে চারটের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে আগ্রহী। |
তখনই মঞ্চে এলেন ডিগ্গি প্রাসাদের মালিক রামপ্রসাদ সিংহ। “রাজস্থান পুলিশের পরামর্শে ভিডিও-বৈঠক বাতিল করে দিয়েছি। ডিগ্গি প্রাসাদের ভিতরে অনেকে ঢুকে পড়েছেন, রাস্তা বেয়ে অনেকে মিছিল করে এ দিকে এগিয়ে আসছেন। অযথা হিংসা এড়াতে, আমার প্রাসাদ বাঁচাতে এবং সন্তানদের নিরাপত্তার খাতিরে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম,” বললেন তিনি। রামপ্রসাদের এই ডিগ্গি প্রাসাদে পাঁচ বছর আগেও এসেছেন রুশদি, ফিরে গিয়ে ‘জয়পুর আমার অন্যতম প্রিয় সাহিত্য উৎসব’ লিখেওছিলেন। আজ সেই রামপ্রসাদও বিপর্যস্ত!
সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে আশাহত তিনিও। “ভিডিও-লিঙ্ক বাতিল করার সিদ্ধান্তটি জঘন্য। সাহিত্য উৎসবে হিংসা ও হামলার হুমকি দিয়ে বাক-স্বাধীনতাকেই আজ রুদ্ধ করল মুসলিম সংগঠনগুলি। প্রকৃত গণতন্ত্রে শুধু হামলাবাজ নয়, সকলেরই বলার অধিকার থাকে,” সন্ধ্যায় ট্যুইট করেছেন রুশদি। সাহিত্য উৎসবে তাঁর ভিডিও-সাক্ষাৎকার আটকে দেওয়া হলেও সন্ধ্যায় একটি ইংরেজি চ্যানেলের মাধ্যমে রুশদি ছড়িয়ে পড়েন গোটা দেশে। সেই সাক্ষাৎকারে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের দিকে তাকিয়েই এটা করা হয়েছে।” এখানেই না থেমে বুকারজয়ী লেখকের ক্ষোভ, “এ রকম যদি চলতে থাকে, তা হলে ভারতে আর মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে না!”
কেন সকালে সরকারি অনুমতি সত্ত্বেও বিকেলের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হল মৌলবাদী চাপে? লনেই দেখা হল ‘সারা ভারত মিল্লি কাউন্সিল’-এর রাজস্থান শাখার সভাপতি আব্দুল লতিফের সঙ্গে। “এখানে আমাদের দু’হাজার ছেলে রয়েছে। বাইরে ডিগ্গি প্রাসাদের রাস্তায় আরও হাজার। সাহিত্য উৎসবের কতৃর্পক্ষ কথা দিয়েছিলেন, রুশদি আসবেন না। কিন্তু এখন তো ভিডিওতে আনা হবে,” হুমকি দিচ্ছিলেন তিনি।
দু’হাজার লোক! মুখের কথা! লনে এবং ডিগ্গি প্রাসাদের এখানে-ওখানে ছড়িয়ে উত্তেজিত একশো মুখ। ডিগ্গি প্রাসাদে ঢুকতে এত পুলিশ এবং মেটাল ডিটেক্টরের কড়াকড়ি, তবু এঁরা ঢুকলেন কী ভাবে? “আমরা রোজই আসি। কোনও দিন উপদ্রব করি না। আজও শান্তিপূর্ণ ভাবেই কতৃর্পক্ষের কাছে বিক্ষোভ দেখিয়েছি। স্বরাষ্ট্রসচিব এবং মুখ্যসচিবের কাছেও গিয়েছিলাম,” বলছেন লতিফ। জামাত-ই-ইসলামির সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ সেলিম ইঞ্জিনিয়ার আরও ক্ষুব্ধ, “এত জন লেখক এখানে। কিন্তু আমাদের ধর্মে যে আঘাত দিয়েছে, তার পিছনে সবাই এ ভাবে লেগে থেকে তাকে নায়ক বানাচ্ছেন কেন?” |
কিন্তু রুশদি তো পাঁচ বছর আগেও এখানে এসেছিলেন! “চুপি চুপি চোরের মতো এসে চলে গিয়েছিল, আমরা জানতে পারিনি। কিন্তু এ বার তো অন্য ব্যাপার। সাংসদ মহেশ জোশী আমাদের সঙ্গে আলোচনায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, রুশদি আসবেন না। সে বার কিন্তু বিজেপি সরকার ছিল,” রাগে ফুঁসছেন মিল্লি কাউন্সিলের সভাপতি। রাজনীতির গল্পটা এখান থেকে পরিষ্কার। এমনিতে আজকের অনুষ্ঠানের নাম ছিল ‘মিডনাইটস চাইল্ড’। ২৫ বছরের বুকার পুরস্কারে সম্মানিত উপন্যাসগুলির মধ্যে সেরার সেরা ‘বুকার অব বুকার’ পাওয়া ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ নিয়ে অনুষ্ঠান। ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ সংক্রান্ত প্রসঙ্গ থাকবে না বলেও উৎসব কর্তৃপক্ষ সকালে রাজস্থান সরকারকে জানিয়েছিলেন।
এ দিন ভিডিও-সম্প্রচার বাতিল হওয়ার পরেই মাইক্রোফোন হাতে জাভেদ আখতার গর্জে উঠলেন, “যে কোনও গোঁড়ামিই মারাত্মক! হিন্দু গোঁড়ামির কারণে হুসেনের মতো শিল্পীকে প্রবাসে মারা যেতে হয়েছে। তার পর আজ এই ঘটনা। কিন্তু আমরা মুখ খুলি না। এই রাজ্যে ‘জোধা-আকবর’ ছবিটিও নিষিদ্ধ হয়েছিল। এখানে গোঁড়া হিন্দু আছে, গোঁড়া মুসলিম আছে। তাদের চাপে আমরা, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয়রাই আজ সংখ্যালঘু।” সেখানেই থামছেন না তিনি, “একটা বই বা সিনেমা নিষিদ্ধ হতেই পারে, কিন্তু নিষিদ্ধ মানে আমি পরিচালককে ঢুকতে দেব না? লেখককেই আসতে দেব না?” লন তখন ফেটে পড়ছে হাততালিতে। ললিতকলা অ্যাকাডেমির প্রাক্তন চেয়ারম্যান অশোক বাজপেয়ীও গলা মেলালেন তাঁর সঙ্গে, “স্যাটানিক ভার্সেস বইটা কাস্টমস আইনে নিষিদ্ধ। মানে বইটা এ দেশে আনা যাবে না। কিন্তু পড়া যাবে না বা লেখক এ দেশে ঢুকতে পারবেন না, এমন কথা বলা নেই।” আর এই মৌলবাদীদের হুমকির জেরে যাঁকে শেষ জীবনটা পরবাসে কাটাতে হয়েছিল, সেই মকবুল ফিদা হুসেনের পুত্র সমসাদের গলাতেও উঠে এসেছে তীব্র ক্ষোভ। বাবার মতো নিজেও চিত্রশিল্পী সমসাদ। রুশদির ভিডিও-সম্মেলন বাতিলের খবর পেয়ে বললেন, “ওঁর সঙ্গে যা হল, তা জঘন্য! আমি নিশ্চিত, এই সব নীতিহীন লোকগুলো, যারা এই সব প্রতিবাদ জানাচ্ছে, তাঁরা শিল্পের কিচ্ছু জানে না। এরা শুধু প্রতিবাদের জন্যই প্রতিবাদ করছে।”
১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট রাত বারোটায় জন্মানো সালিম সিনাই এই ভারতীয় দোলাচলের কথা জানে। রুশদির ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ উপন্যাসের নায়ক সালিম। উপন্যাসে আছে, ওই সময়ে হাসপাতালে যে ছেলেমেয়েরা জন্মেছিল, সকলেরই টেলিপ্যাথি ক্ষমতা ছিল। জাদু-বাস্তবতায় আচ্ছন্ন উপন্যাস। ‘কুছ নাহি’ রাজ্যের রাজা এবং রানি থেকে সুন্দরবনের আধিভৌতিক জঙ্গল, ষাটের দশকে মরাঠি ভাষা নিয়ে মুম্বইয়ের আন্দোলন, জরুরি অবস্থা কত কী-ই যে প্রত্যক্ষ করেছিল সালিম! সালিমের স্রষ্টা অবশ্য আজ আরও বেশি একটু দেখলেন। সকালে সরকারের আশ্বাস সত্ত্বেও বিকেলে আইনশৃঙ্খলাকে পাত্তা না দিয়ে মৌলবাদী হুঙ্কার। সম্পত্তি এবং প্রাণ বাঁচানোর দায়ে, পুলিশি অনুমতি সত্ত্বেও উদ্যোক্তাদের ভিডিও-সম্প্রচার বাতিল করে দেওয়া। ভারতীয় জাদু-বাস্তবতা! |