ফিল্মোৎসবের উদ্বোধনকে নন্দনের ঘেরাটোপ থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন আমজনতার নেতাজি ইন্ডোরে। এ বার বইমেলার উদ্বোধনেও অনেকটা সেই ছবি। বরাবরের ৩০-৩৫ মিনিটের গুরুগম্ভীর অনুষ্ঠান নয়, পাক্কা আড়াই ঘণ্টার সাংস্কৃতিক উৎসব। যার পুরোটাই হল কার্যত খোলা মঞ্চে, সর্বসাধারণের চোখের সামনে। অর্কেস্ট্রা, শ্যাডোগ্রাফি, ‘কলকাতা সাহিত্য উৎসব’-এর উদ্বোধন আর স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর তিনটি এবং আরও অনেক বইয়ের প্রকাশ অনুষ্ঠানের সাক্ষী হয়ে থাকলেন বইপ্রেমী আমজনতা। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বইমেলার আয়োজনের ভাবনায় অবশ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হেঁটেছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দেখানো পথেই।
মেলার মাঠের ভাড়ায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া ছাড়ই কেবল বহাল রাখা নয়, মমতা এ দিন দরাজ গলায় প্রশংসা করেছেন পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের কর্তাদেরও। সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় মনে করিয়ে দিয়েছেন, রাজ্য সরকার এক সময় বইমেলা করত। সেই মেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে এটাই কলকাতার একমাত্র বইমেলা। দীর্ঘ সময় ধরে সেটা গিল্ডই করে আসছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ভাল হোক মন্দ হোক, ওরাই এত দিন ধরে মেলা করছে। আড়ালে ওদের সমালোচনা করুন। কিন্তু এটা মানতেই হবে যে, ওরা ভাল কাজ করছে।”
এ বারের থিম ইতালি। কলকাতা বইমেলার প্রথা মেনে কাঠের পাটাতনে কাঠের হাতুড়ি ঠুকে এ দিন বিকেলে মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ইতালির সাংবাদিক ও সাহিত্যিক বেপ্পে সেভেরনিনি। তাঁর একটি বইয়ের বাংলা অনুবাদ ‘চোখের আলোয় ইতালি’ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী।
|
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয় কলকাতা মিউজিক আকাদেমির অর্কেস্ট্রা দিয়ে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতে তাঁরা ইউরোপীয় মাস্টারদের বিশ্ববিশ্রুত কয়েকটি ‘পিস’ বাজিয়ে শোনান। ইউরোপীয় সুরের প্রভাব আছে, এমন কয়েকটি গান বাজান অনুষ্ঠানের শেষে। প্রায় জনসভার মতো উপচে পড়া ভিড়ে কত জন তার গুণগ্রাহী ছিলেন, সে প্রসঙ্গে না গিয়েও বলা যায়, অর্কেস্ট্রার মূর্ছনা অনুষ্ঠানকে পরিবর্তনের সুরে বেঁধে দেয়। জনসভায় যেমন হয়, বসার আসন আর ভিড়ের ঠেলাঠেলিতে মাঝেমধ্যেই হট্টগোল শুরু হয়ে যায়। তারই মধ্যে দর্শকদের জন্য বড় চমক ছিল শান্তনু মৈত্রের সুরে কৌশিকী দেশিকান আর মোনালি ঠাকুরের গান। ওই গানটিই এ বার কলকাতা সাহিত্য উৎসবের থিমসঙ্গীত। সঙ্গে বৈদ্যুতিন পর্দায় দেখা গিয়েছে অমর-সব্যসাচীর শ্যাডোগ্রাফি।
উদ্বোধনী মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, “বই আমাদের অন্তরের মিউজিয়াম। শাড়ির এগ্জিবিশনে যেমন নানা রকমের শাড়ি প্রদর্শন করা হয়, বইমেলাতেও অনেক রকমের বই এনে হাজির করা হয়।” মমতা এ দিন ঘোষণা করেন, রাজ্য সরকার এ বার স্বামী বিবেকানন্দ এবং কাজী নজরুল ইসলামের রচনাবলী প্রকাশ করবে। এ দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নজরুল ইসলামের পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী। মমতা জানান, কল্যাণীদেবী তাঁকে বলেছেন, তাঁর কাছে নজরুলের সাড়ে তিন হাজার গান আছে, যেগুলো এখনও গাওয়াই হয়নি। সেগুলো প্রকাশ করার প্রসঙ্গেই তিনি রচনাবলী প্রকাশের কথা ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি অনেক দিন আগেই পাঁচ খণ্ডে নজরুল রচনাবলী প্রকাশ করেছে।
এ দিন মেলার উদ্বোধন হলেও বইমেলা সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হবে আজ, বুধবার থেকে। কিন্তু মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় কোনও স্টলই প্রস্তুত হয়নি। গোটা মাঠ জুড়ে স্টল তৈরি হচ্ছে। মিলনমেলা প্রাঙ্গণে স্টল তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত এক ঠিকাদার জানালেন, এখনও পর্যন্ত যা অবস্থা, গোটা মেলা পুরোপুরি প্রস্তুত হতে আরও অন্তত তিন দিন লাগবে। গিল্ডের যুগ্ম সম্পাদর সুধাংশু দে অবশ্য দাবি করেন, বৃহস্পতিবারের মধ্যেই সমস্ত স্টল তৈরি হয়ে যাবে। |