ভারতের নাগরিকদের জন্য ইউনিক আইডেনটিটি কার্ড বা একক পরিচয়পত্র তৈরির কাজটি, বহুবিধ বাধা সত্ত্বেও, চলিতেছে। কুড়ি কোটি মানুষের পরিচয়পত্র তৈরির কাজ ইতিমধ্যেই শেষ। প্রকল্পটির কর্ণধার নন্দন নিলেকানি জানাইয়াছেন, ২০১৪ সালের মধ্যে ষাট কোটি মানুষের পরিচয়পত্র তৈরি হইবে। এই প্রকল্প লইয়া আপত্তি অনেকই ছিল। সেই আপত্তিগুলির কত শতাংশ বাস্তব, কতখানি ভিত্তিহীন তাহা ভিন্ন প্রসঙ্গ। সকল ভারতীয়ের জন্য একক পরিচয়পত্র নির্মাণের কাজটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, রাজনৈতিক ভাষ্যে যাঁহারা ‘আম আদমি’, এই পরিচয়পত্র কার্যত তাঁহাদের পরিচয় নির্মাণ করিবে। কথাটি শুনিতে অদ্ভুত, কিন্তু তাহা বাস্তব। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ মানুষের কোনও পরিচয়পত্র নাই। পাসপোর্ট তাঁহাদের নিকট অশ্রুতপূর্ব একটি শব্দ, ড্রাইভিং লাইসেন্স অলীক, অপ্রাসঙ্গিক। সমস্যা হইল, এই প্রমাণপত্রগুলি না থাকিলে, শুধুমাত্র নির্বাচনী পরিচয়পত্রের জোরে আধুনিক অর্থনীতিতে প্রবেশ করা চলে না। ব্যাঙ্ক ঋণ বা সেই জাতীয় উচ্চমার্গের সুবিধার কথা উহ্যই থাকুক, সরকার দরিদ্র মানুষের জন্য যে বিপুল ভর্তুকির ব্যবস্থা করে, তাহারও নাগাল পাওয়া যায় না। শুধু নিজের পরিচয়টুকু প্রতিষ্ঠা করিতে না পারিবার ফলে তাঁহারা অনুন্নয়নের অন্ধকারের চিরস্থায়ী বাসিন্দা হইয়া থাকেন। একক পরিচয়পত্র সেই অতি জরুরি পরিচয়টি নির্মাণ করিয়া দিবে। প্রকল্পটিকে এই প্রেক্ষিতে দেখাই বিধেয়।
‘আম আদমি’-র যাহা প্রাপ্য, সরকার যে অর্থ তাঁহাদের জন্য প্রতি বাজেটে বরাদ্দ করে, সেই প্রাপ্য হইতে তাঁহাদের বঞ্চিত করিবার প্রক্রিয়াটিই দুর্নীতি। গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনায় ভুয়া মজুরি হইতে গণবণ্টন ব্যবস্থায় বরাদ্দ খাদ্য হইতে মানুষকে বঞ্চিত করা দুর্নীতি সর্বত্র। এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভও প্রবল। পশ্চিমবঙ্গের রেশন-কাণ্ড হইতে ভারতীয় রাজনীতির মূল মঞ্চে অণ্ণা হজারের উল্কাসম উত্থান সবই মানুষের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণের ফল। এই দুর্নীতির একটি প্রধান সহায় মানুষের পরিচয়পত্রহীনতা। রেশন দোকানে যাঁহার চাল পাওয়ার কথা, বৈদ্যুতিন যন্ত্রে তাঁহার হাতের ছাপ না পড়া পর্যন্ত যদি সেই চাল বিক্রয় না করা যায়, তবে চুরি কমিবে নিশ্চয়। যদি পরিচয়পত্রের ম্যাগনেটিক চিপের সংকেত না মেলা পর্যন্ত কর্মসংস্থান যোজনার মজুরির টাকা তোলা না যায়, ভুয়া শ্রমিকের সংখ্যা কমিতে বাধ্য। বস্তুত, অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ-এর সমীক্ষায় স্পষ্ট যে রাজ্যগুলিতে গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে বণ্টিত খাদ্যপণ্যের হিসাব ডিজিটাল ব্যবস্থার মাধ্যমে রাখা হইয়াছে, সেই রাজ্যগুলিতে চুরির পরিমাণ কমিয়াছে। অর্থাৎ, প্রক্রিয়াটি আংশিক ভাবে স্বচ্ছ হইলেও তাহার কুশলতা বৃদ্ধি পায়। একক পরিচয়পত্র এই বণ্টনের প্রক্রিয়াটিকে বহুলাংশে স্বচ্ছ করিবে। সুতরাং আশার বিলক্ষণ কারণ আছে।
প্রায় দুই বৎসর পূর্বে কেন্দ্রীয় সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৌশিক বসু ভর্তুকির ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ অর্থ বণ্টনের প্রস্তাব করিয়াছিলেন। প্রস্তাবটি সরকারি ভর্তুকির প্রক্রিয়াটিকে পাকাপাকি ভাবে বদলাইয়া দিতে পারে। সেই প্রস্তাবের সম্যক বাস্তবায়নের জন্যেও একক পরিচয়পত্রের কোনও বিকল্প নাই। কারণ, একমাত্র এই ডিজিটাল প্রক্রিয়াটির মাধ্যমেই কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে একটি যথার্থ দারিদ্র মানচিত্র নির্মাণ করা সম্ভব, সেই মানচিত্রে দেশের প্রায় পঞ্চাশ কোটি দরিদ্র মানুষের প্রত্যেককে চিহ্নিত করা সম্ভব। কাহার কী প্রয়োজন, কতখানি প্রয়োজন, সরকারের পক্ষে তাহা জানিবার একমাত্র পথ এই একক পরিচয়পত্র। বস্তুত, এই পরিচয়পত্রটি সরকারের সহিত ‘আম আদমি’-র যোগাযোগের সেতু। সরকার যাঁহাদের সাহায্য করিতে নৈতিক ভাবে বাধ্য, একক পরিচয়পত্র তাঁহাদের সরকারের সম্মুখে উপস্থিত করিবে। স্বাধীন ভারতের সাড়ে ছয় দশকে এই প্রথম বার। |