মার্ক্সের ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র আদলে এখন বলা যায়, সোমবার, সাহিত্য উৎসবের চতুর্থ দিনেও জয়পুরকে সলমন রুশদির ভূত তাড়া করছে।
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় হরি কুঞ্জরু-অমিতাভ কুমাররা ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ থেকে পাঠ করার পরে চার লেখকের নামে থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। সোমবার সেই অভিযোগে উৎসবের প্রযোজক সঞ্জয় রায়ের নামও ঢোকানো হল। তবে শুধু সঞ্জয়ই নন, উৎসবের দুই পরিচালক নমিতা গোখলে ও উইলিয়াম ডালরিম্পলের নামেও অভিযোগ দায়ের হয়েছে। “শুনেছি, কিন্তু এখনও কাগজটা হাতে পাইনি,” বললেন সঞ্জয়। সোমবার সন্ধেবেলাতেও রাজস্থানের স্বরাষ্ট্র দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন দিল্লিবাসী এই বঙ্গসন্তান। রাতের দিকে উৎসবের আয়োজকদের তরফে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করা হল। তার পরে সঞ্জয় জানালেন, সব ঠিক থাকলে কাল, মঙ্গলবার বিকেল পৌনে চারটে নাগাদ সাহিত্য উৎসবে ভিডিও কনফারেন্স করতে পারেন রুশদি।
আসলে এই ভিডিও কনফারেন্স নিয়েই এ দিন নানা টালবাহানা চলেছে। ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ নিয়ে কি মুখ খুলবেন রুশদি? দিনভর জল্পনা ছিল এটা নিয়েই। লেখক হরি কুঞ্জরু তো এ দিন এ বিষয়ে টুইটও করলেন। “রুশদি ভিডিও কনফারেন্স করবেন। আর তাতে ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ নিয়ে বলবেন না তো কি ফ্যাশন আর আবহাওয়া নিয়ে কথা বলবেন?” টুইটারে লিখেছেন কুঞ্জরু। যদিও রাতের দিকে উদ্যোক্তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন ভিডিও কনফারেন্সে ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ নিয়ে কথা বলবেন লেখক। ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ নিয়ে আলোচনার প্রশ্নই নেই।
সাহিত্য উৎসব চলছে। আর মাঝেমধ্যেই ঘুরে ফিরে আসছে রুশদি প্রসঙ্গ। এ দিন সকালে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের লেখিকা জামাইকা কিনকেডের সঙ্গে একটি অধিবেশনে হরি কুঞ্জরুর থাকার কথা ছিল। হরি নেই, ফলে জামাইকার সঙ্গে আলোচনায় বসলেন বুকারজয়ী লেখক মাইকেল ওনদাতজে। বিকেলে জয়পুর পৌঁছলেন বিজ্ঞানের লেখক রিচার্ড ডকিন্স। “রুশদির ঘটনার নিন্দার ভাষা নেই। শিক্ষার অভাব। শিক্ষা পেলেই তো মানুষ আধুনিক, ধর্মহীন হয়ে উঠবে।” বললেন ‘সেলফিশ জিন’-এর লেখক।
‘স্যাটানিক ভার্সেস’ নিয়ে তোলপাড় তো নতুন নয়। কিন্তু যে দেশটা নিয়ে রুশদি তাঁর ‘শেম’ উপন্যাস লিখেছিলেন? পাকিস্তানে নিষিদ্ধ সেই উপন্যাস। প্রয়াত বেনজির ভুট্টোর আদলে সেখানে নায়িকা চরিত্রের নামই ছিল ‘মিস ভারজিন আয়রনপ্যান্ট’। লৌহ-পাতলুন আবৃতা কুমারী। সেই বেনজির ভুট্টোর ভাইঝি দু’দিন ধরে জয়পুরে আছেন। জিন্স আর ফুলহাতা ‘ব্লু-ব্ল্যাক’ জামার ওপর পাটকিলে-হলুদ লেদার জ্যাকেট। “এখন বইতে সই দেওয়া ছাড়া আর কিছু করব না, কথাও বলব না,” সোমবার সকালে বললেন ফতিমা ভুট্টো। এ দিন বিদেশ মন্ত্রকের উদ্যোগে ‘প্রতিরোধের লেখালেখি’ শীর্ষক একটি অধিবেশনের সঞ্চালনা করছিলেন তিনি। কয়েক মাস আগেও ইমরান খানের দলে ফতিমা যোগ দিতে পারেন বলে জোর গুজব ছিল। কিন্তু এখানে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে ফতিমা সটান বলে দিলেন, “প্রশ্নই ওঠে না। ইমরান শুধু সামরিক কর্তাদের নয়, মুশারফের মতো একনায়কেরও ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পাকিস্তানে ইমরানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি বরং বিপজ্জনক।” |
জয়পুর সাহিত্য উৎসবে বেনজির ভুট্টোর ভাইঝি, পাকিস্তানি লেখিকা ফতিমা ভুট্টো। ছবি: এ এফ পি |
বিতর্কিত হরি কুঞ্জরু উড়ে গিয়েছেন নিউ ইয়র্কে। এখান থেকেই কলকাতার উড়ান ধরছেন ‘জাপানিজ ওয়াইফ’-এর লেখক কুণাল বসু এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লন্ডনবাসী লেখিকা তহমিনা আনম। দু’জনেই কলকাতা সাহিত্য উৎসবে আমন্ত্রিত। “কলকাতার উৎসবটা কেমন হচ্ছে?” জিজ্ঞাসা করছিলেন লেখিকা।
ডিগ্গি প্রাসাদে তো এ বার রীতিমতো ভিড়। কিন্তু মিলনমেলার জনসমুদ্র লন্ডনবাসিনীর চোখে কেমন লাগবে, তা ভবিষ্যতের বিবেচ্য। কলকাতার বাঙালি লেখকেরাও আজকাল ওই ভিড় নিয়ে সন্দিহান। “আমরা কুড়ি লক্ষ লোকের ভিড়টাই দেখি। কিন্তু কোথাও খামতি থেকে যাচ্ছে। কলকাতার বাঙালিদের হাজার ভাগের এক ভাগও বাংলা বই পড়েন না।” ক’দিন আগেই কলকাতায় দুঃখ করছিলেন সমরেশ মজুমদার।
বঙ্গসন্তানের বাংলা বই পড়া, না-পড়ার তর্ক বরং থাকুক। ‘ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান চেম্বার অ্যান্ড কমার্স’-এর হিসেব, এ দেশে ইংরেজি প্রকাশনার বাজার এখন প্রায় ১৪০ কোটি ডলারের। এবং প্রতি বছর সেই বাজার গড়ে ১০ শতাংশ বাড়ছে। ‘পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া’র সিইও অ্যান্ড্রু ফিলিপ্স জানাচ্ছিলেন, এই ১৪০ কোটি ডলারের ভারতীয় বাজারে তাঁরাই সবথেকে এগিয়ে। ‘পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া’র সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব শুরু হল জয়পুর থেকেই। তাজ প্যালেস হোটেলের এক পার্টিতে দেখা গেল পেঙ্গুইনের প্রতীক নিয়ে ‘টোয়েন্টি ফাইভ’ লেখা লাল অ্যাম্বাসাডার। সুবর্ণজয়ন্তীতে সারা দেশে ঘুরে বেড়াবে সেই গাড়ি। জয়পুরের পরবর্তী গন্তব্য, কলকাতা বইমেলা। সুবর্ণজয়ন্তীর পার্টিতে যোগ দিতে মুম্বই থেকে জয়পুরে উড়ে এসেছিলেন শোভা দে। “পেঙ্গুইন আমার কাছে পরিবারের মতো,” বলছিলেন ‘স্টারি নাইট্স’-এর লেখিকা।
গ্ল্যামার, ব্যবসা, ইংরেজি, বাংলা। এ সব ছাড়া জয়পুর আর কলকাতার মধ্যে আরও একটা বড় তফাত রয়েছে। ভাবনার তফাত! আগামী কাল কলকাতা সাহিত্য উৎসবের প্রথম অধিবেশনে ‘স্বামী বিবেকানন্দ’। ২৬ তারিখ ‘সার্ধশতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ’। ঘটনাচক্রে আগামী বছরেই উর্দু লেখক সাদাত হাসান মান্টোর শতবর্ষ। এ দিন সন্ধ্যায় মান্টোর ‘টোবা টেক সিংহ’ গল্পটি নিয়ে নানা কথা বললেন প্যালেস্তাইনের আচিয়া আনজি।
মনে আছে গল্পটা? দেশভাগের পর সৈন্যদের গুলিতে ঝাঁঝরা টোবা টেকের মরদেহ ঝুলে রয়েছে কাঁটাতারে। এক দিকে ভারত, অন্য দিকে পাকিস্তান। টোবা টেক জানেন না, কোনটি তার দেশ! আচিয়া সেই গল্প হিব্রু ভাষায় অনুবাদ করেছেন। “ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সমস্যাতেও মান্টো কী ভাবে অনুষঙ্গ বজায় রাখেন, সেটা বোঝার জন্যই আচিয়াকে ডেকেছি। মান্টো মহান লেখক ছিলেন। তাঁর লেখা পড়া উচিত। এ সব বলা অর্থহীন। ও সব বছরের অন্য সময় হবে। আমরা নিজস্বতা বজায় রাখতে চেয়েছি।” বললেন উৎসবের অন্যতম পরিচালক নমিতা গোখলে। |