বিধ্বংসী আগুনে সব হারানো মানুষদের হাহাকার আগেও দেখেছে শহর। অগ্নিকাণ্ডের পরে সামাল দেওয়ার ব্যবস্থাও নতুন কিছু নয়। তবে, রবিবার সন্ধ্যার আগুনে ছারখার কালিকাপুরের বস্তিতে যে দ্রুততায় রাতারাতি শুরু হয়ে গেল ত্রাণের কাজ, তা বিপর্যয় মোকাবিলার ক্ষেত্রে একটা দৃষ্টান্ত হতে পারে। ঘটনার রাতেই ই এম বাইপাসের কালিকাপুর ৩ নম্বর বস্তি থেকে ঢিল-ছোড়া দূরত্বে কেএমডিএ-র জমিতে কলকাতা পুরসভার উদ্যোগে বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে তৈরি হয়েছে অস্থায়ী শিবির। পুরসভার ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের কর্মী এবং জেলা প্রশাসনের সঙ্গে ত্রাণকার্যে সামিল হয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয় এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। শিবিরের পরিবারগুলির জন্য খাবারের ব্যবস্থা করছে ওই সব সংস্থাই। রাতেই ক্ষতিগ্রস্তদের খিচুড়ি খাওয়ায় তারা। সোমবার সকালেও ছিল জলখাবারের ব্যবস্থা।
সদ্যোজাত থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, সকলেই একে একে মাথা গুঁজেছেন ওই শিবিরে। রাতেই ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন শিবিরে যান মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান, বিদ্যুৎমন্ত্রী তথা যাদবপুরের বিধায়ক মণীশ গুপ্ত ও সাংসদ সুব্রত বক্সী। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যাপারে রাজ্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হবে বলেও জানিয়েছেন আলিপুরের মহকুমাশাসক তনবীর আবজল।
ক্ষতিগ্রস্ত ৮৩টি ঝুপড়ির (সরকারি হিসেবে) জন্য যে ভাবে রাতারাতি ত্রাণের ব্যবস্থা হয়েছে কালিকাপুরে, তাতে খুশি স্থানীয় বাসিন্দারাও। অলোক কর নামে এক কিশোর বলে, “রাতে খিচুড়ি, সকালে ঠিক সময়ে ডিম-রুটি-কলা খেয়েছি। খাবারের জন্য আলাদা করে কাউকে কিছু বলতেও হয়নি।” |
ত্রাণের কাজে রাজ্যের ভূমিকা নিয়ে কোনও প্রশ্ন বা অভিযোগ তোলেননি বিরোধীরাও। এ দিন ত্রাণ শিবিরে গিয়ে দুর্গতদের সঙ্গে কথা বলেন প্রাক্তন সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ও। তাঁর উদ্যোগে কম্বল ও বিস্কুট বিতরণ করা হয়।
পোড়া বস্তিতে এ দিনও ছিল হাহাকারের ছবি। রবিবার যখন আগুন লাগল, বস্তির বাসিন্দা রিকশাচালক শম্ভুনাথ হালদার তখন সপরিবার গিয়েছিলেন একটি বিয়েবাড়িতে। পুড়ে যাওয়া রিকশার চাকাগুলোর দিকে ফ্যাকাশে চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রৌঢ় বললেন, “সাড়ে ১০টার সময় যখন ফিরলাম, তখন বাঁচানোর মতো আর কিছুই পড়ে নেই ঘরে।”
কোথাও আধপোড়া খাটে বসে থাকা মা কোলের শিশুর গায়ে জড়িয়ে দিচ্ছেন চাদর। কেউ বা ‘ঘরের লোক’-এর হাতে হাত মিলিয়ে ভাঙা শো-কেস, আলমারি থেকে বার করছেন একের পর এক ভেজা কাগজ। ছাই ঘেঁটে চলছে অক্ষত জিনিসপত্র টেনে বার করার আপ্রাণ চেষ্টা। কেউ-কেউ ঝিল বা খালের কোমরজলে নেমে খুঁজছেন গত সন্ধ্যায় আগুন থেকে বাঁচাতে ছুড়ে ফেলা প্রয়োজনীয় জিনিস। অক্ষত ঘরের বাসিন্দাদের সঙ্গে দু’নম্বর বস্তির লোকেরাও দুর্ঘটনার পরপরই নেমে পড়েছেন সাহায্যে।
এ সবের মধ্যেই ছাই হয়ে যাওয়া ঝুপড়িতে বসে ছিলেন গোপীনাথ পৈলান। গত বছর বি কম পাশ করেছেন। ফোসকা পড়া ডান হাতটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ভাগ্যিস রেজাল্টের ফাইলটা টেনে বার করতে পেরেছিলাম...”, কথা শেষ হয় না যুবকের। গোপীনাথ পারলেও, অস্থায়ী শিবিরে ঠাঁই পাওয়া অনেক শিশু-কিশোরই কিন্তু একটা বইও বাঁচাতে পারেনি।
এ দিন অস্থায়ী শিবিরে গিয়ে প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে আলোচনার পরে শোভনবাবু বলেন, “ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে ঘর তৈরি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারদের সেই মতো নির্দেশও দিয়েছি।” আলিপুরের মহকুমাশাসক বলেন, “ইটের মেঝেতে দরমা ও বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঘর তৈরির পরিকল্পনা হয়েছে। পরিবারপিছু ১০০ বর্গফুটের একটি ঘর দেওয়া হবে। শৌচালয় তৈরিও শুরু হয়েছে।” ঝুপড়িগুলিতে যে ৩৫ জন স্কুলপড়ুয়ার বাস, তাদের এক জন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী বলে পুরসভা সূত্রে খবর। শোভনবাবু বলেন, “পড়ুয়াদের বই দেওয়ার ব্যবস্থার সঙ্গে ইতিমধ্যেই শিশুদের জামা-কাপড় এবং মহিলাদের শাড়ি বিতরণ শুরু হয়েছে।” |