মেমো নম্বর একই। কিন্তু নির্দেশনামার বয়ান আলাদা। একটি পাঠিয়েছেন রাজ্য পুলিশের ডিজি। অন্যটি তাঁকে উদ্ধৃত করে পাঠিয়েছে রাজ্য গোয়েন্দা দফতর (আইবি)। আর তাই নিয়ে তৈরি হয়েছে রহস্য।
নির্দেশনামার বিষয়বস্তু রাজনৈতিক সংঘর্ষ। আইবি-র পাঠানো বার্তায় ডিজি-র নাম করে পরিষ্কার লেখা হয়েছে, রাজ্যে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংঘর্ষের বিভিন্ন ঘটনায় ‘আক্রমণকারী’র ভূমিকা নিয়েছে সিপিএম এবং ‘আক্রান্ত’ তৃণমূল। জানুয়ারির গোড়ায় রেডিওগ্রাম মারফৎ ওই নির্দেশনামা বিভিন্ন জেলার পুলিশ অফিসারদের হাতে পৌঁছয়। তার পরেই আলোড়ন, খোঁজখবর এবং প্রশ্ন: রাজ্য পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তা কি এ ভাবে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের নাম করে শাসকদের ‘আক্রান্ত’ এবং বিরোধীদের ‘আক্রমণকারী’ বলে চিহ্নিত করতে পারেন?
সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়েই রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর ও পুলিশের উপর মহল অন্য রকম রহস্যের গন্ধ পেয়েছে। প্রাথমিক ভাবে তাঁদের হাতে যেটুকু তথ্য এসেছে তাতে সন্দেহ, রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়ের নাম করে উদ্ধৃতি দিয়ে একই মেমো নম্বর উল্লেখ করে কিছু ‘বিতর্কিত’ কথা বসিয়ে নতুন করে বার্তাটি লেখা হয়েছে। এর পিছনে কোনও ‘গভীর অভিসন্ধি’ থাকার সম্ভাবনাও সরকার উড়িয়ে দিচ্ছে না। শুরু হয়েছে তদন্ত। দায়িত্ব
ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায় |
দেওয়া হয়েছে এডিজি পদমর্যাদার এক অফিসারকে।
ডিজি-র নির্দেশনামার মেমো নম্বর আইএস ৩৩৪৭/ডিজি/১২। আইবি-র পাঠানো বার্তাতেও ওই মেমো নম্বরই উল্লেখ করা হয়েছে। তারিখও একই ৩ জানুয়ারি। যে বার্তাটি নিয়ে সন্দেহ তাতে ডিজি-কে উদ্ধৃত করে বাঁকুড়া, বর্ধমান, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর প্রভৃতির নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এই সব জেলায় সিপিএম ‘সক্রিয় হামলাবাজি’ করছে এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থকেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার ‘শিকার’।
কিন্তু ওই মেমো নম্বরে পাঠানো ডিজি-র নির্দেশনামায় কোনও রাজনৈতিক দলের নামগন্ধ নেই। রাজনৈতিক সংঘর্ষ সামাল দিতে ওসি-আইসি এবং গোয়েন্দা পুলিশের কী করণীয় তা-ই কেবল বলা হয়েছে। এই ধরনের গোলমাল মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারদের কর্তব্যে গাফিলতি হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা অবশ্য দু’টি ক্ষেত্রেই রয়েছে। যেমন বলা হয়েছে রাজনৈতিক সংঘর্ষের আগাম খবরাখবর সম্পর্কে তৎপর থাকতে হবে জেলা গোয়েন্দা বিভাগকেও।
এক পুলিশ কর্তা বলেন, “জেলা গোয়েন্দা পুলিশ রাজনৈতিক সংঘর্ষ সংক্রান্ত যে খবর সদর দফতরে পাঠায় তাতে সাধারণ ভাবে অভিযুক্তদের নাম, কোন দলের কর্মী-সমর্থক তা বিস্তারিত জানায়। তার ভিত্তিতে আইবি-র সদর দফতর থেকে পুলিশ-প্রশাসনের কাছে যে রিপোর্ট যায় তাতেও খুঁটিনাটি বলা থাকে।”
কিন্তু পুলিশের সর্বোচ্চ স্তর থেকে যখন ওই ব্যাপারে কোনও নির্দেশ নিচুতলায় পাঠানো হয়, তাতে কোনও রাজনৈতিক দলের উল্লেখ থাকে না বলে একাধিক প্রাক্তন ডিজি জানিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, “এসপি, ডিআইজি বা আইজি-দের পাঠানো বার্তায় মূলত রাজনৈতিক সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হওয়ার আশঙ্কার কথাই জানানো হয়। অফিসারদের কী করা উচিত তারও নির্দেশ থাকে।” |
তা হলে কী ভাবে একই মেমো নম্বর উল্লেখ করে এ রকম ‘বিতর্কিত’ কথা লেখা রেডিওগ্রাম জেলায় জেলায় চলে গেল এবং কেনই বা তা তৎক্ষণাৎ পুলিশ কর্তৃপক্ষের নজরে এল না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রশাসনেরই একাংশ। এর পিছনে কোনও ষড়যন্ত্র রয়েছে, না নিছকই কর্তব্যে গাফিলতি, সেই প্রশ্নও বড় হয়ে উঠেছে।
স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা জানান, ডিজি-র অফিস থেকে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের নির্দেশ পাঠানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে ডিজি-র অনুমতি নিয়ে সেই পুরনো নির্দেশ উল্লেখ করে জেলার অফিসারদের নতুন করে বার্তা পাঠায় আইবি। এ ক্ষেত্রে সেই অনুমতি নেওয়া হয়েছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বার্তা পাঠানোর সমস্ত সরকারি প্রক্রিয়া মানা হয়েছিল কি না, তা নিয়েও তদন্ত হচ্ছে। এমনকী, কোন পরিস্থিতিতে কে বা কারা ডিজি-র উদ্ধৃতিতে রাজনৈতিক দলের নামোল্লেখ করার বিষয়টি চূড়ান্ত করেছেন, তা-ও খুঁজে বার করতে চাইছে স্বরাষ্ট্র দফতর।
প্রবীণ অফিসারদের বক্তব্য, ডিজি-র অনুমতি ছাড়া কিছু কথা সংযোজন করে বেতারবার্তা পাঠানো হয়ে থাকলে তা শৃঙ্খলাভঙ্গের সামিল। সেই কারণে দ্রুত রহস্যের উদ্ঘাটন জরুরি বলে মনে করেন ওই পুলিশ কর্তারা। না হলে আগামী দিনে পুলিশের মধ্যে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা দানা বাঁধতে পারে বলে তাঁদের আশঙ্কা।
|
বার্তা বৃত্তান্ত |
• ডিজি-র মৌখিক নির্দেশে বার্তার খসড়া লেখেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী
• ডিজি-র অনুমোদনের পরে তা ওয়ারলেস মারফত পাঠানো হয়
• আইবি তা ফের পাঠাতে চাইলে আইজি-এডিজি খসড়া দেখে দেন
• চূড়ান্ত অনুমোদন দেন ডিজি
• আইবি-র নিজস্ব রিপোর্টে অভিযুক্তের রাজনৈতিক পরিচয় থাকে
• নিরপেক্ষতা রাখতেই ডিজি-র নির্দেশে দলের নাম থাকে না |
|