তিনি লীলা পারুলেকর নন। কিন্তু প্রায় তাঁরই সমবয়সী।
পুণের বাসিন্দা, ৭৩ বছর লীলার মতো অসহায় জীবের রক্ষার জন্য তিনি ট্রাস্ট গড়েননি। কিন্তু সীমিত ক্ষমতায় তিনিও অসুস্থ-বৃদ্ধ কুকুর-বেড়ালের আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছেন। প্রায় একার চেষ্টায় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গড়ে দশ কর্মী রেখে খুলেছেন দাতব্য চিকিৎসালয়।
বর্ধমানে বোরহাটের বাড়িতে তৃপ্তি চক্রবর্তী যখন কাজটা শুরু করেছিলেন, তাঁকে প্রায় কেউই চিনত না। কিন্তু যত সময় গড়িয়েছে, তাঁর কাজকর্মের পরিধি বেড়েছে। অসুস্থ প্রাণীদের নিজের বাড়িতে রাখা ছাড়াও রাস্তায় নেমে কুকুরদের টিকাকরণ থেকে সচেতনতা শিবির পরিচালনা পর্যন্ত। এ বার নিয়ে পরপর তিন বছর রাজ্য সরকারের প্রাণিকল্যাণ দফতরের স্বীকৃতি পেয়েছে তাঁর কাজ।
ফরাসি মা-মরাঠি বাবার সন্তান লীলার সঙ্গে আরও এক জায়গায় কিছু মিল আছে মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরের কন্যা তৃপ্তির। সেই মিল আপাত নিঃসঙ্গতায়। পশুদের জন্য গোটা জীবনটাই উৎসর্গ করে দিয়েছেন অকৃতদার লীলা। ১৩০টা কুকুর আর গোটা পঁচিশ অন্য প্রাণীর জন্য গোটা বাংলো ছেড়ে দিয়ে তিনি নিজে থাকেন কার্যত শৌচাগার হিসেবে ব্যবহারের উপযোগী ছোট্ট একটি ঘরে। |
তৃপ্তি সংসার পেতেছিলেন। স্বামী প্রশান্ত চক্রবর্তী ছিলেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-গ্রন্থাগারিক। তিনি নিজে শিক্ষকতা করতেন বর্ধমান মহারানী অধিরানী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। পড়াতেন ইতিহাস ও বাংলা। ১৯৮৮ সাল নাগাদ ভাড়াবাড়ি ছেড়ে বোরহাটে বাড়ি করে উঠে আসেন। পাঁচিল তখনও পুরো হয়নি। বাড়ির হাতায় ঢুকে ১৫টা বাচ্চা দিয়েছিল দু’টো কুকুর। তাদের প্রতি মায়া জন্মে গিয়েছিল নিঃসন্তান তৃপ্তির। তাঁর মনে পড়ে, “এক রাতে খুব ঘেউ-ঘেউ শুনে উঁকি দিয়ে দেখি, একটা গোখরো সাপ এসেছে। ভিতরটা ছটফট করে উঠেছিল। মরিয়া হয়ে টর্চ নিয়ে বেরোতেই সাপটা সরে যায়। কিন্তু আমি আর ঝুঁকি নিতে চাইনি। একটা-একটা ১৫টা কুকুরছানাকে আঁচলে নিয়ে ঘরে চলে আসি।”
সেই শুরু। জেলার পশুপালন দফতরে যাওয়া-আসা শুরু করেন তৃপ্তি। জেনে নিতে থাকেন, কী ভাবে অসুস্থ কুকুর-বেড়ালের যত্নআত্তি করতে হয়, কী করে কোন ওষুধ দিতে হয়। ১৯৯৫ সালে স্কুল থেকে অবসর। বাকি জীবনটা এই অবলা জীবদের নিয়েই কাটাবেন স্থির করে তার এক বছর আগেই গড়েন একটি সংস্থা। অবসর নিয়ে খুলে ফেলেন পশুদের ক্লিনিক। প্রশান্তবাবু সরাসরি কাজে যোগ দেননি, কিন্তু বাধাও দেননি। ২০০৪ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে কার্যত এই কুকুর-বেড়ালেরাই বৃদ্ধার এক মাত্র সঙ্গী।
প্রথমটা সহজ ছিল না। তৃপ্তি বলেন, “অবসর নেওয়ার সময়ে যে টাকা পেয়েছিলাম, তার থেকে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। আমার এবং স্বামীর পেনশন মিলিয়ে যে টাকা পাই, তারও বেশির ভাগটা এই কাজেই যায়।” এখন ২০-২৫ হাজার টাকা কেন্দ্রীয় সাহায্য মেলে। ২০০৯ এবং ২০১১ সালে বর্ধমান জেলা পরিষদ রাস্তার কুকুরের টিকাকরণের জন্য এক লক্ষ টাকা করে দিয়েছে। ওই পর্যন্তই। বাড়ির সামনে রাখা সাহায্যের বাক্সে কখনও-সখনও কেউ দু’-দশ টাকা ফেলে যায়। বাকিটা খরচ চলে তাঁর নিজের সঞ্চয় থেকেই।
কিন্তু এ সব নিয়ে তৃপ্তির তত মাথাব্যথা নেই, যতটা রয়েছে কুকুর-বেড়ালের প্রতি বহু মানুষের নির্মম ব্যবহার নিয়ে। তাঁর কথায়, “অনেকেই কুকুর-বেড়াল অপছন্দ করেন। বাড়ির আশপাশে কুকুরের বাচ্চা ঘুরতে দেখলে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলারও চেষ্টা করেন। এমন অত্যাচারিত অনেক কুকুরকে পাড়ার পশুপ্রেমীরা আমার কাছে নিয়ে এসেছেন। আমি চিকিৎসা অনেকগুলিকে বাঁচিয়ে বাড়িতে রেখে দিয়েছি।”
প্রায় অথর্ব লীলা এখন হুইল চেয়ারে বন্দি। কিন্তু সেই অবস্থাতেও জন্তু-জানোয়ারের দেখভাল করে চলেছেন। সে দিক থেকে তৃপ্তি একটু এগিয়েই আছেন। বার্ধক্য এখনও তাঁকে পঙ্গু করেনি। ক্লিনিক সব সময়ে খোলা থাকে না। কাঁপা হাতে অসুস্থ পশুকে ইঞ্জেকশন দিতে বা খাবার খাওয়াতে তাঁকে দেখা যায় প্রায়ই। সংস্থার দুই কর্মী তাঁর বাড়িতে থাকেন। বাকিটা আপাতত ২২টি আহত-বৃদ্ধ কুকুর আর ৬টি বেড়ালের দখলে।
তবু শান্তি নেই বৃদ্ধার। তাঁর আর্জি, “পছন্দ না হলে কুকুরের শরীরে পেট্রোল ঢেলে, বেড়ালকে নর্দমায় ডুবিয়ে মারার চেষ্টা করবেন না। আমার বাড়িতে দিয়ে যান। সামনা-সামনি দিতে লজ্জা করলে বাড়ির সিঁড়িতে ছেড়ে কলিং বেল বাজিয়ে চলে যাবেন।” সত্যি বলতে, আজকাল মাঝে-মধ্যে দরজা খুলে চোখ না ফোটা কুকুর-বেড়ালের ছানা শুয়েও থাকতে দেখেন তিনি। কোলে করে ভিতরে নিয়ে যান। “এই কুকুর-বেড়ালেরাই তো আমার সন্তান” বলতে বলতে এক আশ্চর্য তৃপ্তি ফুটে ওঠে বৃদ্ধার মুখে। |