নিরাপত্তার জন্য মাইন নিরোধক (অ্যান্টি ল্যান্ডমাইন) গাড়িতে চড়ে যাচ্ছিলেন ওঁরা। কিন্তু মাওবাদীদের পুঁতে রাখা ল্যান্ডমাইনের ধাক্কায় উড়ে গেল পুলিশ বোঝাই গোটা গাড়িটাই! শনিবার দুপুরে ঘটনাটি ঘটেছে ছত্তীসগঢ় লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের গঢ়বা জেলার ভাণ্ডারিয়ায়। পঞ্চাশ দিনে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার। এর আগে গত ৩ ডিসেম্বর ঝাড়খণ্ডের লাতেহারে মাওবাদীদের পুঁতে রাখা ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে ১০ জন পুলিশের মৃত্যু হয়। এ দিনের বিস্ফোরণে ১৩ জন পুলিশের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ভাণ্ডারিয়া থানার ওসি রাজবলী চৌধুরিও রয়েছেন। বিস্ফোরণে গুরুতর আহত দুই পুলিশকর্মীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ দিনের বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই ছিল যে, প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে ছত্তীসগঢ়ের বলরামপুর থানা এলাকার পুলিশও তা শুনতে পেয়েছে!
ঝাড়খণ্ড পুলিশ জানিয়েছে, ভাণ্ডারিয়ার বাঢ়গঢ় গ্রামের কাছে একটি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরিকে কেন্দ্র করে এ দিন সকাল থেকে স্থানীয় গ্রামবাসীদের নিয়ে অনশন শুরু করেছিলেন গ্রামের মুখিয়া রামদাস মিনজ্। বাঢ়গঢ় এবং লাগোয়া এলাকায় বন্ধও শুরু হয়। একটি সূত্রের বক্তব্য, গ্রামবাসী ও মুখিয়াদের দাবিতেই গঢ়বা জেলা পরিষদের অধ্যক্ষ সুষমা মেটা এবং ভাণ্ডারিয়া ব্লকের বিডিও বাসুদেব প্রসাদ পুলিশ নিয়ে অনশন এবং বন্ধ তুলতে যান। বিডিও বাসুদেববাবু ছিলেন প্রথম গাড়িটিতে। তার পিছনে ছিল পুলিশের অ্যান্টি ল্যান্ডমাইন গাড়ি এবং একেবারে পিছনের গাড়িতে ছিলেন সুষমা মেটা। গঢ়বা পুলিশ জানায়, পাকা সড়ক ধরেই যাচ্ছিল গাড়িগুলি। বেলা সওয়া ১১টা নাগাদ সালো জঙ্গলের লালমাটিয়া গ্রামে বিডিও-র গাড়িটি পেরিয়ে যাওয়ার পরেই মাইন বিস্ফোরণ হয়। বিস্ফোরণে উড়ে যায় অ্যান্টি ল্যান্ডমাইন গাড়িটি। |
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের বক্তব্য, বিস্ফোরণের ধাক্কায় চুরমার হয়ে যায় গাড়িটি। ভিতরে থাকা পুলিশকর্মীদের দেহ বাইরে ছিটকে পড়ে। এ সময় জঙ্গলের মধ্যে থেকে ৫০-৬০ জনের একটি দল বেরিয়ে এসে দেহগুলি লক্ষ করে নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে বলেও একটি সূত্রের বক্তব্য। শুধু তা-ই নয়, মাওবাদীরা পুলিশের ১৩টি রাইফেল, ওয়াকিটকি, অয়্যারলেস সেট এবং মোবাইল ফোনগুলি লুঠ করে। ফলে বিস্ফোরণের খবর থানায় পৌঁছয় দেরিতে। পরে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় পুলিশ ও সিআরপিএফ। তত ক্ষণে শ’দেড়েক মাওবাদী জড়ো হয়ে যায়। দু’পক্ষে বেশ কিছুক্ষণ ধরে গুলির লড়াই চলে। তবে তাতে দু’পক্ষের কেউ হতাহত হয়নি। শেষ পর্যন্ত মাওবাদীরা জঙ্গলে গা ঢাকা দেয়। গঢ়বার পুলিশ সুপার মাইকেল রাজ জানান, বিস্ফোরণে নিহতদের অধিকাংশই ঝাড়খণ্ড সশস্ত্র পুলিশের (জ্যাপ-৭) কনস্টেবল।
পুলিশ জানায়, বিস্ফোরণের পরে সিআরপিএফ ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর আগেই মাওবাদীদের পঞ্চাশ জনের একটি দল পথ আটকায় সুষমা মেটা, তাঁর দেহরক্ষী এবং গাড়ি চালকের। তাঁদের অপহরণও করা হয়। এ দিন সন্ধ্যায় সালো জঙ্গলে সুষমাদেবীকে মাওবাদীরা ছেড়ে দিয়েছে বলে একটি সূত্রে জানানো হলেও পুলিশ জানিয়েছে, রাত পর্যন্ত সুষমাদেবীকে পাওয়া যায়নি।
এ দিন সন্ধ্যায় ঘটনাস্থলে যান ঝাড়খণ্ড পুলিশের ডিজি গৌরীশঙ্কর রথ। মাওবাদীদের খোঁজে চিরুনি তল্লাশি শুরু হয়েছে জঙ্গল ও লাগোয়া এলাকায়। সতর্ক করা হয়েছে ছত্তীসগঢ় পুলিশকেও। তবে ছত্তীসগঢ়ের পুলিশ কর্তারা জানিয়েছেন, গঢ়বা থেকে ছত্তীসগঢ় ঢুকতে গেলে কানহা নদী পার হতে হয়। বিস্ফোরণের শব্দ পেয়েই নদী এবং সংলগ্ন এলাকা ‘সিল’ করে দেওয়া হয়। ফলে মাওবাদীরা ঝাড়খণ্ডেই আটকে রয়েছে বলে ধারণা তাঁদের। |
এ দিনের বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে উঠে এসেছে মাওবাদীদের ‘ফাঁদ’-এর তত্ত্ব। যে ভাবে পুলিশ, বিডিও এবং জেলা পরিষদের অধ্যক্ষকে ঘটনাস্থলে টেনে আনা হয়েছে, তা যথেষ্টই সন্দেহজনক মনে হয়েছে পুলিশ কর্তাদের কাছে। একই কথা বলছেন লাগোয়া ছত্তীসগঢ়ের পুলিশ কর্তারাও। যে মুখিয়ার নেতৃত্বে আন্দোলন চলছিল, সেই রামদাস মিন্জ-সহ গ্রামবাসীদের একটা বড় অংশই মাওবাদীদের সঙ্গে জড়িত বলে মনে করছেন অনেকে। একই সন্দেহ কোনও রকমে বেঁচে যাওয়া বিডিও বাসুদেববাবুরও। তবে গঢ়বার ডেপুটি কমিশনার বলেন, “মাওবাদীরা ফের পুলিশ খুন করে সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি করতে চাইছে। কিন্তু তাতে লাভ হবে না। গঢ়বার মানুষ মাওবাদীদের কাজকর্মে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছেন।”
কিন্তু পাকা রাস্তায় কী করে মাইন পুঁতল মাওবাদীরা? ঝাড়খণ্ড পুলিশের এক কর্তা জানান, যে এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে, সেখানে বসতি কম। রাতের অন্ধকারে কোনও এক সময় মাইন পুঁতে রাখা হয়েছিল বলে তাঁর অনুমান। তবে ঝাড়খণ্ড পুলিশের প্রাক্তন এক ডিজি জানান, রাজ্য জুড়ে অসংখ্য জায়গায় আগে থেকেই মাইন পুঁতে রেখেছে মাওবাদীরা। কেবল তারাই জানে কোথায় কোথায় সেগুলি পোঁতা রয়েছে। প্রয়োজন মতো সেগুলি ব্যবহার করে।
|
মাইন-রোধী গাড়ি কেমন |
• ভিতরের অংশ মোটা গদি দিয়ে মোড়া, যাতে বিস্ফোরণে উল্টোলেও জওয়ানরা নিরাপদ থাকেন
• তলাটা নৌকার মতো
• উপরের দিকে দু’টো গর্ত, নিরাপদে বেরোনোর জন্য
• কোনও কোনও গাড়ির বাইরেটা বুলেটপ্রুফ চাদরে ঢাকা
|
তা হলে গঢ়বায় ধ্বংস হল কেন |
ঝাড়খণ্ড পুলিশের ব্যাখ্যা |
• মাইন ফাটলে গাড়ির ক্ষতি হবে না, এমন নয়। তবে প্রাণহানির সম্ভাবনা কম থাকে। মাইন খুব শক্তিশালী হলে (৯০ কেজি বা
তার বেশি) বিপদের আশঙ্কা বেশি। গঢ়বার ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে।
|
|
|
শনিবার সৈকত চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।
|