দলের পঞ্চায়েতি রাজ সম্মেলনে দীর্ঘ এক ঘণ্টার বক্তৃতায় কংগ্রেসের নাম কার্যত নিলেনই না তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বেশ কিছুদিন ধরে দুই শরিকের যে চাপানউতোর চলছে, সেই আবহে বিরোধী তো বটেই, শাসক শিবিরেরও কৌতূহল ছিল মমতা জোটসঙ্গী সম্পর্কে কী বলেন! কিন্তু তৃণমূল নেত্রী সে পথেই হাঁটেননি।
কেন, তা নিয়ে প্রত্যাশিত ভাবেই তৃণমূলের অন্দরে দু’রকম মতামত রয়েছে। ‘কট্টর’রা (যাঁরা সাম্প্রতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে কংগ্রেসকে ছেড়ে একলা চলার পক্ষপাতী) মনে করছেন, কংগ্রেসেকে পুরোপুরি ‘উপেক্ষা’ করেছেন দলনেত্রী। যে কারণে তিনি বলেছেন, পঞ্চায়েত ভোটে ‘আমরা’ জিতব। আবার দলের যাঁরা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট রেখে রাজ্যে সরকার-চালানো দু’দলের মধ্যে ‘ঐক্যে’র ছবি তুলে ধরতে আগ্রহী, তাঁদের মতে, কংগ্রেসের সঙ্গে ‘সংঘাত’ আপাতত এড়িয়ে চলতে চাইছেন নেত্রী। বৃহস্পতিবার নেতাজি ইন্ডোরে দলীয় সম্মেলনের একেবারে শেষ দিকে মমতা বলেছেন, “যাঁরা আসতে চান, আসুন। সকলকে নিয়েই কাজ করতে হবে।” যে বিষয়টি উদ্ধৃত করে দলের একাংশ বলছেন, মমতা পঞ্চায়েত ভোটে জোটেরই ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে শীর্ষ নেতাদের একাংশের আবার অভিমত, “কংগ্রেস নয়। আমাদের দলের জনপ্রিয়তায় অন্য রাজনৈতিক দল থেকে আগতদেরই আহ্বান জানিয়েছেন নেত্রী।” |
মমতা নিজে ঘনিষ্ঠমহলে জানিয়েছেন, তিনি এখনও জোটের বিষয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না। কারণ, ভোটের এখনও অনেক দেরি আছে। তবে রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কথায় ইঙ্গিত মিলেছে, রাজ্য সরকার পঞ্চায়েত ভোট এগিয়ে আনতে পারে। সম্মেলনে সুব্রতবাবু বলেন, “২০১২-র ঠান্ডা থাকতে থাকতে ভোট করলে ভাল হয়।” রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট নির্দিষ্ট ২০১৩ সালের মে-জুন নাগাদ। মমতা নিজেও এর আগে একাধিক বার ঘনিষ্ঠমহলে ভোট এগিয়ে ২০১২-র ডিসেম্বরে করার কথা বলেছেন। সে দিক থেকে সুব্রতবাবু মুখ্যমন্ত্রীর মনোবাসনাই সর্বসমক্ষে জানিয়েছেন। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় কংগ্রেস-তৃণমূলের যে ‘সমীকরণ’ এবং আপাতত উভয়পক্ষের যা ‘সম্পর্ক’, তাতে জোট হওয়া নিয়ে খানিকটা অনিশ্চয়তা তো রয়েইছে। কিন্তু মমতা এদিন কংগ্রেসের নামোল্লেখ না-করায় তৃণমূলে এই ধারনাও হয়েছে যে, তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে এখনই সঙ্ঘাতে যেতে চাইছেন না। বস্তুত, মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে পাল্টা কোনও ‘মন্তব্য’ না-করতে। যে ভাবে প্রতিদিন তৃণমূলের মন্ত্রীরা কংগ্রেসকে ‘কটাক্ষ’ করে চলছিলেন, তা যে তিনি পছন্দ করছেন না, তা-ও জানিয়েছিলেন মমতা। বৃহত্তর ‘রাজনৈতিক স্বার্থ এবং রাজ্যে উন্নয়নে’র কাজে আরও মনোনিবেশ করতেই মুখ্যমন্ত্রী শরিকের সঙ্গে সঙ্ঘাতে সময় ব্যয় করতে চান না বলেই তৃণমূলের একাধিক প্রথমসারির নেতা জানিয়েছেন। দলের সভায় নিজেই তার উদাহরণ দিয়ে দেখালেন মুখ্যমন্ত্রী।
মমতার মতোই সম্মেলনের অন্যান্য বক্তাও সরাসরি কংগ্রেস সম্পর্কে কোনও কথা বলেননি। তাঁদের আক্রমণের একমাত্র লক্ষ্য ছিল প্রধান বিরোধী দল সিপিএম। তার সঙ্গেই লক্ষ্য ছিলেন প্রাক্তন পঞ্চায়েত মন্ত্রী, অধুনা বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। ‘ব্যতিক্রম’ রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। যিনি কংগ্রেসের নাম না করে বলেন, ‘‘ধানের সহায়ক মূল্য ও কৃষকের মৃত্যু নিয়ে সিপিএম ছাড়াও আরেকটি রাজনৈতিক দল অপপ্রচার করছে। দলের কর্মীদের বলছি, আপনাদের গ্রামে ফিরে এর জবাব দিতে হবে।” |
জোটশরিকের সঙ্গে লড়াইয়ে না-গিয়ে মমতা এদিনের মঞ্চকে ব্যবহার করেছেন জোট সরকারের গত সাতমাসের ‘সাফল্যে’র খতিয়ান দিতে। যা থেকে স্পষ্ট, ওই বিষয়টিকেই তিনি আগামী পঞ্চায়েত ভোটে ‘হাতিয়ার’ করতে চান। দলের কর্মীদের নেত্রী বলেছেন, “আমরা কী কাজ করেছি, তা সিডি করে দেব। সেই সিডি আপনারা গ্রামে-গ্রামে, পঞ্চায়েতে-পঞ্চায়েতে দেখাবেন।” গ্রামোন্নয়নের কাজে তদারকির জন্য দলের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে নিয়ে একটি নতুন কমিটির কথাও ঘোষণা করেন মমতা। বলেন, “নতুন কমিটির নাম কৃষিজমি রক্ষা ও গ্রামোন্নয়ন কমিটি।” সেখানে মমতা রেখেছেন সৌগত রায়, মুকুল রায়, সুদীপ বন্দোপাধ্যায়, চৌধুরী মোহন জাটুয়া, পার্থ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ নেতাদের। এলাকাগত ভাবে বিধায়ক-সাংসদদের নিয়ে ওই কমিটি উন্নয়নের কাজ পর্যালোচনা করবে। এ ছাড়াও দলের জেলা সভাপতিদের মমতা নির্দেশ দিয়েছেন, “বিধায়ক, সাংসদ এবং পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যদের নিয়ে একটা করে কোর গ্রুপ গঠন করে ১৫ দিন অন্তর বৈঠক করবেন। তার পর দলকে তার রিপোর্ট পাঠাবেন।” মুখ্যমন্ত্রী মমতা আরও জানিয়েছেন, পঞ্চায়েতে এ বার পুরস্কার এবং তিরস্কারের ব্যবস্থা থাকবে। অর্থাৎ, যে পঞ্চায়েত ভাল কাজ করছে, তারা পুরস্কৃত হবে। যারা ব্যর্থ, তারা তিরস্কৃত।
পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে দু’মাস আগে নেতাজি ইন্ডোরেই একই রকম সম্মেলন’ করে মমতা তথা তৃণমূলের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছিলেন কংগ্রেস নেতারা। মমতা তার পাল্টা কিছু বলেন কিনা, তা নিয়ে রাজনৈতিক শিবিরে জল্পনা ছিল। কিন্তু মমতা বক্তৃতার পুরো সময়টাই ব্যয় করেছেন তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের ‘সাফল্য’ ও বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের শাসনের ‘ব্যর্থতা ও দুর্নীতি’ নিয়ে। সমস্ত দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত হবে বলে মমতা ও সুব্রতবাবু জানান। সিপিএমকে তুলোধোনা করে মুখ্যমন্ত্রী মমতার দাবি, “সিপিএম ৩৪ বছরে সর্বনাশ করে দিয়ে গিয়েছে। আমরা স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনবই।”
তাঁদের আমলে যে ‘পর্যাপ্ত’ কাজ হয়নি, তা মেনে নিয়েছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবুও। তাঁর কথায়, “আমাদের সময়ে যা হয়েছিল, তা পর্যাপ্ত ছিল বলে মনে করি না। এটা মানতে কোনও অসুবিধাও নেই। কিন্তু যেটুকু করেছিলাম, ওঁরা সেটাও ভেঙে ফেলতে চাইছেন!”
তৃণমূল নেত্রীর বক্তৃতায় একবারেই সরাসরি কংগ্রেস প্রসঙ্গ এসেছে। রাজ্যে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পূর্ব মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা ছাড়া কোনও জেলা পরিষদই তৃণমূলের হাতে নেই। রয়েছে অধুনা বিরোধী বামফ্রন্ট বা সিপিএমের হাতে। সেই জেলা পরিষদগুলির বিরুদ্ধে উন্নয়নের কাজে ‘গাফিলতি’র অভিযোগ তুলে মমতা বলেন, “উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদ কোনও কাজই করছে না! একই সমস্যা মুর্শিদাবাদেও।” তিনি ‘হুঁশিয়ারি’ দিয়ে বলেন, “গরিব মানুষের কাজ আটকানো কোনও ভাবেই সহ্য করব না। সে সিপিএম, কংগ্রেস অথবা বিজেপি যারাই ক্ষমতায় থাকুক না কেন!” সরকারে আসার পরেই বিরোধীদের হাতে-থাকা পঞ্চায়েতগুলি ‘অচল’ বলে অভিযোগ তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। প্রশাসনের সহযোগিতায় সেই পঞ্চায়েতগুলিকে ‘সচল’ করার চেষ্টা শুরু করেছেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে বিরোধীদের পাশাপাশি শরিক কংগ্রেসও সরব হয়েছিল।
সেই প্রসঙ্গ তুলে মমতা বলেন, “বাম আমলে ২০১০ সালে ৬৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। আমি কিন্তু একটিও ভাঙিনি!” মমতার ডাকে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী শিশির অধিকারী মঞ্চে বলেন, “মাত্র দেড় লাইনের আদেশে ৬৫টা গ্রাম পঞ্চায়েত এবং ৭টি পঞ্চায়েত সমিতি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল ২০১০ সালে।” যে অভিযোগের জবাবে বিরোধী দলনেতার প্রতিক্রিয়া, “এ ভাবে কোনও পঞ্চায়েতই ভেঙে দেওয়া হয়নি! কোথা থেকে এ কথা বললেন কে জানে!”
মমতা অবশ্য অন্যান্য দিনের মতোই এদিনও বিরোধীদের মুখে ‘লিউকোপ্লাস্ট’ লাগিয়ে রাখতে বলেছেন। শুধু তার সময়সীমা ১০ বছর থেকে একলাফে বেড়ে হয়েছে ৩৪ বছর! সরকারের সমালোচনা করায় সংবাদমাধ্যমকেও একহাত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তার চেয়ে মমতা অনেক বেশি মনোযোগ দিয়েছেন পঞ্চায়েত ভোটের প্রাথমিক প্রস্তুতিতে। এই সম্মেলনকে পঞ্চায়েত ভোটের ‘প্রাথমিক প্রস্তুতি’ (সম্মেলনে তৃণমূলের সমস্ত পঞ্চায়েত সদস্যকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল) ধরে নিয়েই ভরা নেতাজি ইন্ডোরে জেলাওয়াড়ি দলীয় নেতৃত্বকে দায়িত্ব ভাগ করে দিয়ে জেলাসদর ও ব্লকে-ব্লকে সম্মেলনের নির্দেশ দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ মার্চের মধ্যে সেই সম্মেলন শেষ করার সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছেন। মমতা জানিয়েছেন, এপ্রিলের মধ্যে তিনি নিজে জেলা সফরে যাবেন। তার পর দলের বিভিন্ন শাখা সংগঠনের ‘ব্রিগেড সম্মেলন’ও করবেন তিনি। |