মুর্শিদাবাদে বিএসএফ জওয়ানরা এক বাংলাদেশিকে পাচারকারী সন্দেহে নগ্ন করে মারধর করছে এই ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ার পিছনে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের মদতে চলা মৌলবাদীদের ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তাদের কাছে যে গোয়েন্দা রিপোর্ট এসেছে, সেখানে ভিডিও ফুটেজটি ছড়ানোর সময় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, যখন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ক্রমেই ভাল হচ্ছে, সীমান্তে দু’দেশের অর্থমন্ত্রীদের সাক্ষাৎ হতে চলেছে, ঠিক তখনই দিল্লির অস্বস্তি বাড়াতে পারে, এমন ভিডিও ফুটেজটি ছড়ানো হল কেন?
সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগরতলা সফরে দু’দেশের মধ্যে নতুন করে ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ’ পরিবেশ গড়ে উঠেছে। তার রেশ ধরে রাখতেই শনিবার পেট্রাপোল সীমান্তে যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। সেখানে আসছেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিথ। দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য আরও সুগম করতে পণ্যবাহী ট্রাকগুলিকে দু’দেশের সীমান্ত পেরিয়ে অন্তত ২০০ মিটার প্রবেশাধিকার পাচ্ছে।
ঠিক তার আগে এই ভিডিও প্রচার আসলে দু’দেশের সম্পর্ক ভেস্তে দেওয়ার চেষ্টা কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে গোয়েন্দারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে রিপোর্ট দিয়েছেন।
গত কাল এমএমএসের মাধ্যমে মুর্শিদাবাদে ছড়িয়ে দেওয়া ওই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, বিএসএফের উর্দি পরা কয়েক জন এক যুবককে নগ্ন করে বাঁশে বেঁধে বেধড়ক মারধর করছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পাচারকারী সন্দেহে বাংলাদেশের চাপাই-নবাবগঞ্জ এলাকার আব্দুল শেখ নামের ওই ব্যক্তিকে মারধর করা হয়েছিল। কিন্তু গোয়েন্দা রিপোর্টে প্রশ্ন, পাচারকারীরা ধরা পড়লেও আগে কি তাদের মারধরের ছবি এ ভাবে প্রচার করা হয়েছে? মোবাইলে ওই ছবিগুলি তুললই বা কে? ঘটনাটি ঘটেছে গত সপ্তাহে। তা হলে ঠিক প্রণববাবুর পেট্রাপোল সফরের আগে কেন ভিডিওটি বাজারে ছড়ানো হল? |
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এই রিপোর্ট পেয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে বিদেশ মন্ত্রকেও। বিএসএফের ডিজি-র কাছে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট চেয়েছে সাউথ ব্লক। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র
সৈয়দ আকবরউদ্দিন বলেন, “ঘটনায় পূর্ণাঙ্গ তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ঘটনায় জড়িত আট জন বিএসএফ কনস্টেবলকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গেও এ বিষয়ে তথ্য বিনিময় হচ্ছে। বিএসএফের মুখপাত্র তীর্থ আচার্য জানান, “যে বাংলাদেশি নাগরিককে মারধর করা হয়েছে বলে অভিযোগ, তাঁকেও শনাক্ত করা হয়েছে। তিনি বাংলাদেশে আপাতত সুস্থই আছেন বলে জানতে পেরেছি। ঘটনার তদন্তে উচ্চপর্যায়ের অভ্যন্তরীণ তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র ভারতকে অবিলম্বে এই ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দেওয়ার অনুরোধ করেছেন।
এমন একটা সময়ে ঘটনাটি ঘটল, যখন নানা বাধা কাটিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভাল হতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের বাংলাদেশ সফরে তিস্তা চুক্তি না হলেও, সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আগরতলা সফরের সময় দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও মধুর হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার সাহায্যকে স্বীকৃতি দিয়েছেন হাসিনা। সাধারণত প্রধানমন্ত্রী কোনও দেশে গেলে এত তাড়াতাড়ি সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতে আসেন না। হাসিনা সেই প্রথা ভেঙেছেন।
বিদেশ মন্ত্রকের কর্তারা মনে করছেন, এর প্রভাব দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেও পড়বে।
এই সম্পর্কের উষ্ণতা ধরে রাখতেই শনিবার খোদ প্রণববাবু পেট্রাপোলে যাচ্ছেন। বেনাপোলে আসবেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী। দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যের ৬০-৭০% পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়েই হয়। এত দিন সীমান্তেই মালপত্র ওঠানামা করত। ফলে পণ্য গুদামজাত করা ও তা ফের দেশের ভিতরে নিয়ে যাওয়ায় সমস্যা দেখা দিত। খরচও বাড়ত। ব্যবসায়ীদের তাই দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, বাংলাদেশের ট্রাকগুলিকে ভারতের ভিতরে ২০০ মিটার ঢুকতে দেওয়া হোক। একই ভাবে ভারতের ট্রাকও বাংলাদেশের ২০০ মিটার ভিতরে গিয়ে মালপত্র ওঠানো-নামানোর কাজ করবে। প্রণববাবুর সফরে সেই সিদ্ধান্তই কার্যকর হবে।
ঠিক এই সময় বিএসএফের হাতে বাংলাদেশি নাগরিকের মার খাওয়ার ঘটনা প্রকাশ্যে চলে আসায় যথেষ্ট অস্বস্তিতে পড়েছে নয়াদিল্লি। আর সেখানেই তৈরি হয়েছে সন্দেহ। কারণ, বিএসএফের জওয়ানরা কাউকে মারলেও, তা সকলের সামনে করবেন না। আবার বিএসএফের কোনও জওয়ান সেই ছবি তুলে রেখে প্রচার করছেন, তা-ও যথেষ্ট সন্দেহজনক বিষয়। গোয়েন্দারা মনে করছেন, প্রলোভন দেখিয়ে বিএসএফের নিচুতলার কর্মীদের দিয়ে এই কাজ করানো হতে পারে। ওই এলাকায় মৌলবাদী শক্তির প্রভাব রয়েছে। বিদেশ মন্ত্রকের কর্তাদের বক্তব্য, ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের উন্নতির সম্ভাবনা দেখা গেলেই লস্কর-ই-তইবা, জামাত-উদ-দাওয়ার মতো মৌলবাদী সংগঠনগুলি নাশকতা চালিয়ে বাধা তৈরির চেষ্টা করে। ঠিক তেমনই বাংলাদেশের মৌলবাদী সংগঠনগুলিও নয়াদিল্লি-ঢাকা সুসম্পর্কে সমস্যা তৈরির চেষ্টা করে। এর পিছনে আইএসআইয়ের মদত দেওয়ার সম্ভাবনাও যথেষ্ট। বিশেষ করে বাংলাদেশে এখন মুক্তিযুদ্ধের দোষীদের বিচার চলছে। ফলে জামাতের মতো মৌলবাদী শক্তিগুলি সেখানে কোণঠাসা বলেই কূটনৈতিক মহল মনে করছে। বিশেষ করে ঠিক এই সময় পাকিস্তানের হাইকমিশনার শাহিদ মালিকের কলকাতা সফরও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বিদেশ মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, এক দিকে যেমন তিস্তার জট ছাড়ানোর চেষ্টা চলছে, তেমনই আশুগঞ্জ-আখাউড়া ও চট্টগ্রাম-মঙ্গলাপোর্টের মধ্যে বাংলাদেশের জমি ব্যবহার করে ভারতের পণ্য পরিবহণ নিয়েও আলোচনা এগোচ্ছে। সন্ত্রাস দমনেও হাসিনা ভারতকে সব রকম সাহায্য করছেন। ভারত বাংলাদেশকে ২৯০টি বাস দেবে। ফেব্রুয়ারি মাসেই প্রথম কিস্তির বাস পাঠানো হবে মুম্বই থেকে। ঢাকাকে বিপুল আর্থিক সাহায্যেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দিল্লি। বাংলাদেশের ৩০০ জন ছাত্রকে স্কলারশিপ দেওয়া হচ্ছে। এই সম্পর্কে জল ঢালার চেষ্টা অপ্রত্যাশিত নয়। সেই জন্যই গোটা ঘটনার সামগ্রিক তদন্ত প্রয়োজন বলে মনে করছেন তাঁরা। |