|
|
|
|
রাজপুতানায় সন্ন্যাসী |
পুজো হয় ঝুপড়িতে ঘোরা
সাধুর ছবির, চিঠিরও
গৌতম চক্রবর্তী • আলোয়ার |
|
|
রোজ সকাল-সন্ধ্যায় চিঠিপুজো করেন ৬৯ বছরের রাজারাম গুপ্ত। তাঁর ঠাকুরঘরের কুলুঙ্গিতে উজ্জ্বয়িনীর মহাকাল শিবের ছবি। পাশে প্লাস্টিকের ফ্রেমে মোড়া, কালো কালিতে লেখা একটি চিঠি, ‘মাই ডিয়ার গোবিন্দ সহায়, কয়েক মাস আগে খেতড়িতে তোমার শেষ খবর পেয়েছিলাম...।
নীচে সই ও ঠিকানা, ‘বিবেকানন্দ। ধর্মমহাসভা, শিকাগো। ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা।’ ১৮৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিবেকানন্দ আলোয়ারে আসার পর রাজা মঙ্গল সিংহের
সেনা-দফতরের তরুণ করণিক গোবিন্দ সহায় তাঁর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। রচনাবলিতে গোবিন্দ সহায়কে লেখা কিছু চিঠিও প্রকাশিত। তবে গোবিন্দ সহায়ের পৌত্র রাজারাম এই চিঠিটি কাছছাড়া করেননি। অপ্রকাশিত এই চিঠিটির সামনে তিনি
রোজ ধুপধুনো দেন।
আলোয়ারের অশোকা সিনেমা হলের পিছনে গলির গলি তস্য গলি। তারই মধ্যে পার্টিশন হয়ে-যাওয়া পুরনো বাড়ি। একতলায় মরচে ধরা টিনের ছাউনির ‘আউটহাউস’। ভিতরে নীল চুনকাম-করা দেওয়াল, রাজারামবাবুর ঠাকুরঘর। ‘‘বিবেকানন্দ এই ঘরে থাকতেন। আগে আরও বড় ছিল, পার্টিশন হওয়ার পরে এটুকুই আমার ভাগে।” বললেন তিনি।
খেতড়ির সঙ্গে আলোয়ারের তফাতটা এখানেই। রাজপ্রাসাদ বনাম গরিবের ঝুপড়ি। খেতড়ি যাওয়ার আগে, ১৮৯১ সালে বিবেকানন্দ মেরঠ থেকে দিল্লি হয়ে ট্রেনে প্রথম বার আলোয়ারে আসেন। তখনও তিনি বিখ্যাত হননি, দণ্ড-কমণ্ডলু হাতে, গেরুয়া পরে ‘বিবিদিষানন্দ’ নামের ‘রমতা জোগী’। শিকাগোফেরত বিবেকানন্দ ১৮৯৭ সালে খেতড়ি যাওয়ার আগে আলওয়ারেও পাঁচ-সাত দিন ছিলেন। সে বার তিনি সম্মাননীয় রাজ-অতিথি!
কিন্তু রাজার অতিথি সে বারেও ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন পরিচিত গরিব মানুষগুলোর কাছে। দ্বিতীয় সফরে রাজার লোকেরা এক বার বিবেকানন্দকে খুঁজে পাচ্ছেন না। রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়ে তিনি হঠাৎ উধাও! চারদিকে ‘খোঁজ খোঁজ’ রব। দেখা গেল আমেরিকাফেরত সন্ন্যাসী এক ঝুপড়িতে বসে। ভিতরে এক বৃদ্ধা আটা মেখে রুটি সেঁকছেন। প্রথম বার বিবিদিষানন্দকে ঝুপড়িবাসিনী বৃদ্ধা রুটি, আচার খাইয়েছিলেন। এ বার রাজার কমর্চারীদের উঁকি মারতে দেখে তিনি সন্ত্রস্ত। শোনা গেল, বৃদ্ধা বলছেন, ‘আরে লালা, রাজবাড়িতে বড় সাধু এসেছে, শুনেছিস? রাজার বাড়িতে থাকে, কত লোক তাকে দেখতে যায়। তুই যাবি না?” স্নেহভরে আরও বললেন, “না, তোর এখন খিদে পেয়েছে। আগে একটা টিক্কর (রুটি) করে দিই, খেয়ে নিয়ে না-হয় যাস। তবে বড়িয়া সাধু, রাজপ্রাসাদে থাকে। তোকে কি ঢুকতে দেবে?” বিবেকানন্দ বৃদ্ধার বিশ্বাস উৎপাদনের চেষ্টা করলেন, “মাই, সাধু দেখতে যাবি? আমিই কিন্তু সেই সাধু।” কিন্তু বৃদ্ধা নাছোড়, “দূর, তুই তো মেরা লালা। তুইও গরিব, আমিও গরিব। এ বার টিক্কর দুটো খেয়ে নে।” |
|
মঙ্গল সিংহ |
বিবেকানন্দ সে বার টিক্কর খেয়েই থেমে যাননি। বৃদ্ধার কাছ থেকে কিছু বাজরার আটা নিয়েও এসেছিলেন। সঙ্গীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, মঠে তাঁর ঘরে যেন তা রেখে দেওয়া হয়।
ঝুপড়ির গরিব ‘মাই’ ছিলেন, আর ছিলেন বৈষ্ণব সাধু রামসানাইয়া। তাপ্পি মারা একটি পুরনো ঘটিই ছিল সাধুর সম্বল। একটি নুড়িপাথর দিয়ে সেই ঘটি বাজিয়ে ভজন গাইতেন। বিবিদিষানন্দ পরে বিখ্যাত সন্ন্যাসী হয়েও এই গরিবকে ভুলবেন না। শিষ্য গুপ্ত মহারাজকে বলেছিলেন, “তখন আনন্দে কাটাতাম। জগতের প্রতি দৃকপাত করতাম না, রামসানাইয়া অকপট ভাবে আমাকে ভালবাসত।”
সার্ধশতবর্ষেও সেই ছবি। এমনিতে আলওয়ার খেতড়ির চেয়ে বড় শহর। জেলা সদর, উপরন্তু ৩০ কিলোমিটার গেলেই সরিস্কার জঙ্গল। ফলে প্রশস্ত রাস্তা, অজস্র হোটেল, অফিসকাছারি। শিল্প বাণিজ্য ও পর্যটনে বহুবিধ উন্নতি। খেতড়ির মতো এখানকার রাজপ্রাসাদ ও দুর্গ জীর্ণ, মামলা-ধ্বস্ত নয়। সর্বক্ষণ পর্যটকের ভিড়, একটি প্রদর্শশালাও রয়েছে। বর্তমান রাজা জিতেন্দ্রপ্রতাপ সিংহ-ই এখানকার সাংসদ, ভারতের স্বরাষ্ট্র-প্রতিমন্ত্রী। খেতড়ির মতো এখানেও রাস্তায় বিবেকানন্দের পরিচিত মূর্তি, বাজার এলাকার প্রধান রাস্তায় ‘বিবেকানন্দ চক’। কিন্তু বিবেকানন্দ এখানে প্রাসাদে ছিলেন না। ফলে ২০১২ সালেও তাঁকে কখনও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে রাজারাম গুপ্তর বাড়িতে, কখনও বা সিএমএইচও (চিফ মেডিক্যাল অ্যান্ড হেল্থ অফিসার)-এর অফিসে।
রাজস্থান স্বাস্থ্য দফতরের বাড়িটির সামনের অংশ নতুন। পিছন দিকে পুরনো অংশটি ভাঙা হয়নি। এক তলায় অ্যাকাউন্ট অফিস, দোতলায় রাজ-আমলের ছত্রী। অ্যাকাউন্ট-অফিসে কম্পিউটার, লাল শালুতে বাঁধা হরেক কাগজপত্র। পিছনে বিবেকানন্দের একটি ছবি। সামনে ধূপদানি। “শুনেছি, উনি
বড় সাধু ছিলেন। এই ঘরে থাকতেন। আমরা অফিসে এসে তাই রোজ ছবির সামনে পুজো দিই,” জানালেন দফতরের এক কর্মী। এই অফিস-বাড়িটিই ছিল আলওয়ারের দেওয়ান মেজর রামচন্দ্রের ‘অফিসিয়াল রেসিডেন্স’। রামচন্দ্রের বাড়িতেই সেই বিখ্যাত ঘটনা। জিতেন্দ্রপ্রতাপের প্রপিতামহ মহারাজ মঙ্গল সিংহ সন্ন্যাসীকে বললেন, মূর্তিপুজোয় তাঁর বিশ্বাস নেই। বিবিদিষানন্দ দেওয়াল থেকে রাজার ছবি নামিয়ে দেওয়ান ও অন্যদের তার উপর থুতু ফেলতে বললেন। সকলেই নারাজ। রাজাকে সন্ন্যাসী বুঝিয়ে দিলেন, মূর্তিপুজোর ব্যাপারটা এই রকমই। ভক্তেরা স্রেফ পাথরপুজো করেন না, তার মধ্যে দেবতাকে দেখতে পান।
১৮৯৭ সালে বিবেকানন্দ দ্বিতীয় বার আলওয়ারে আসার সময় মঙ্গল সিংহ আর নেই। বিবেকানন্দ আমেরিকা যাওয়ার আগে, ১৮৯২ সালে বিষ খেয়ে মারা গিয়েছেন তিনি। সিএমএইচও অফিসের দোতলায় পুরনো যে ছত্রী, সেখানে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে দেওয়ান রামচন্দ্রকে। আলওয়ারে তার আগে ফাঁসি ছিল না। রামচন্দ্রই ইংরেজদের দেখাদেখি চালু করেছিলেন, এবং তিনিই সেই প্রথার প্রথম শিকার। এখানে কুঞ্জবিহারি নামে ব্রিটিশদের এক গুপ্তচর ছিল। রামচন্দ্রের ভাড়াটে গুণ্ডাদের হাতে কুঞ্জ খুন হন, ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে ‘অফিসিয়াল রেসিডেন্স’-এর ছত্রীতেই তাঁকে ফাঁসিতে লটকানো হয়। থুতু ফেলার ঘটনাটা আলওয়ারে তাঁর নিজের বাড়িতে। সেই বাড়ি আর নেই, রামকৃষ্ণ মিশনের ইতিহাসে উৎসাহী স্থানীয় তরুণ শশিশেখর শর্মা জানালেন, “উও তো ময়দান বন্ গ্যয়া।”
আলওয়ার প্রাসাদের মিউজিয়ামে রয়েছে মঙ্গল সিংহের ‘মিনিয়েচার’ ছবি। রয়েছে তাঁর পতাকা ও রাজদণ্ড। আছে বিবেকানন্দের জন্মের ৪৩ বছর আগে ১৮২০ সালে ইংল্যান্ডে তৈরি জোড়া তলোয়ার। একই বাঁটে গাঁথা দুটি ফলার এই তলোয়ার মঙ্গল সিংহকে উপহার দিয়েছেন ‘হিজ হাইনেস মহারাজা অব জোধপুর।’ প্রদর্শশালা এবং রাজপ্রাসাদ থেকে রাস্তা সোজা ছুটেছে আলওয়ার দুর্গে। খেতড়ির মতো করুণ অবস্থা নয়, এই দুর্গ সরকারি সম্পত্তি। সামনে পুরাতত্ত্ব দফতরের নীল নোটিসবোর্ড। দুর্গের ছাদে চলছে সংস্কার, এখানেও তৈরি হবে একটি প্রদর্শশালা।
রাজপুত রাজা মঙ্গল সিংহের অন্যতম প্যাশন ছিল শিকার। বিবেকানন্দকে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “এত ইংরেজি জেনেও গেরুয়া পরে ঘুরে বেড়ান কেন?” বিবেকানন্দের পাল্টা প্রশ্ন, “আপনিই বা রাজকাজে সময় না দিয়ে ইংরেজ ইয়ারদোস্তদের সঙ্গে শিকার করে বেড়ান কেন?” মঙ্গল সিংহের উত্তর, “আমার ভাল লাগে।” সন্ন্যাসী বললেন, “আমারও তাই।”
এই নির্ভীক সন্ন্যাসীকে রাজপুত মনে ধরবেই। আলওয়ারের আগে ইংরেজি নাম ছিল ULWAR। সিপাহি বিদ্রোহের পর রাজপুত রাজাদের এক সভা। ইংরেজ রেসিডেন্টরাও আছেন। কোন রাজাকে কোথায় বসানো হবে তা নিয়ে ব্রিটিশরা দ্বিধাগ্রস্ত। ঠিক হয়েছে, ঝামেলায় না গিয়ে বর্ণানুক্রমিক সূচি! আলওয়ারের রাজা বিকানেরের রাজার সঙ্গে গল্প করছেন, ইংরেজ অফিসারের অনুরোধ, “স্যার, প্লিজ যদি পিছনে গিয়ে বসেন।” রাজা বিরক্ত, “কেন?” উত্তর এল, “আপনার রাজ্য U দিয়ে শুরু। ফলে পিছনে বসতে হবে।” রাজপুত মেজাজ চড়ে গেল, “দূর, এখানেই বসব। বানানটা আজ থেকে পাল্টে দাও। ULWAR নয়, ALWAR।”
রাজতন্ত্রে এ রকমই ঘটত!
|
(চলবে) |
|
|
|
|
|